২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সেই সেপ্টেম্বরেই চলে গেলেন ডিন জোন্স

চেন্নাইয়ে জোন্সের সে ইনিংস ম্যাচের গতিই পাল্টে‌ দিয়েছিল।
সংগৃহীত ছবি

সেই সেপ্টেম্বরেই চলে যেতে হবে তাঁকে! কী আশ্চর্য,সেই ভারতের মাটিতেই!
১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে চেন্নাইয়ের মাটিতে নিজের জীবনীশক্তি নিংড়ে দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক এক টেস্টে। টাই হওয়া ইতিহাসের দ্বিতীয় টেস্টে চেন্নাইয়ের তীব্র গরম সহ্য করে খেলেছিলেন ২১০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। স্থান করে নিয়েছিলেন ক্রিকেটের ইতিহাসে। ৩৪ বছর পর ভারতের মাটিতেই চিরবিদায় নিলেন তিনি, এবার মুম্বাই।

ব্যাপারটা কাকতাল মাত্র। তবে জীবনের চিত্রনাট্যে এ রকম অনেক কাকতালই লিখে রাখে প্রকৃতি। জোন্সের জীবনটাও যেন ঠিক তা-ই। প্রকৃতি তাঁকে দিয়ে জীবনের সেরা ইনিংসটি খেলিয়েছিল ভারতের মাটিতে। তাঁর চিরবিদায়ের মঞ্চটাও সেই ভারতের মাটিতেই! সেই সেপ্টেম্বরে।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা তারকা ডিন জোন্স। ছিলেন দর্শক-বিনোদনের অপার উৎস। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর রানের গড়ই বলে দেয় ব্যাটসম্যান হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি। ৫৯ টেস্ট খেলে ৪৬.৫৫ গড়ে ৩ হাজার ৬৩১ রান খুব মন্দ নয়। তবে জোন্স সবকিছু ছাপিয়ে ইতিহাসে রয়ে যাবেন বিখ্যাত সেই টাই টেস্টের জন্যই। ৩৪ বছর আগে চেন্নাইতে খেলা তাঁর সেই ইনিংসটি যে ছিল রক্ত-মাংসের মনুষ্য-সত্তাকে ছাপিয়ে যাওয়া।

১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল আন্ডারডগ হিসেবেই খেলতে এসেছিল ভারতে। মাত্র দুই বছর আগে গ্রেগ চ্যাপেল, ডেনিস লিলি, রডনি মার্শরা অবসরে গেছেন। দলটা তখন ববি সিম্পসনের কোচিংয়ে নিজেদের দাঁড় করানোর চেষ্টায়। প্রতিপক্ষের ওপর চিরদিন চড়ে বসে রাজত্ব করার ব্যাপারটি তখন অনেকটাই অনুপস্থিত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের চরিত্রে। নতুন তারকারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট হারের ক্ষত তখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দলটি। অ্যালান বোর্ডারের নেতৃত্বে সেই ভারত সফর ছিল অস্ট্রেলিয়ার জন্য রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু ভারতের বৈরী কন্ডিশনেও সে পরীক্ষায় দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন ডিন জোন্স।

অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ দেখেছিল চেন্নাই।
সংগৃহীত ছবি

চেন্নাই টেস্টের প্রথম দিনই ভারতীয় স্পিনারদের সামনে বুক চিতিয়ে লড়ে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানেরা নিজেদের ‘আন্ডারডগ’ তকমা কিছুটা হলেও ঘোচাতে পেরেছিল। সেঞ্চুরি করেছিলেন ডেভিড বুন। কিন্তু জোন্সের ২১০ রানের ইনিংসটিকে বলতে পারেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সাহসী ইনিংস।

সে ম্যাচের সময়টায় চেন্নাইয়ে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রির ওপরে। বাতাসেও যেন আগুনের হলকা। প্রচণ্ড গরমে মাঠে বারবার পানিশূন্যতায় ভুগছিলেন ডিন জোন্স। টিকে থাকতে প্রচুর পানি পান করছিলেন। ৫০৩ মিনিটের সেই ইনিংসে জোন্স খেলেছিলেন ৩০৩ বল। ২৭টি বাউন্ডারির সঙ্গে মেরেছিলেন ২টি ছক্কাও। কথাগুলো এখন তরতর করে লিখে দেওয়া গেলেও সেদিন জোন্সই কেবল বুঝেছিলেন কতটা কঠিন ছিল ব্যাটিং করা। একপর্যায়ে উইকেটের ওপরই বমি করে দিয়েছিলেন তিনি। যখন আউট হন, তখন এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁকে দ্রুত নিতে হয়েছিল স্থানীয় এক হাসপাতালে।

জোন্সের ইনিংসটি আরও বেশি মহিমান্বিত হয়ে ওঠে ম্যাচের ফলাফলের কারণে। ম্যাচ তাঁর ক্যারিয়ারেরই মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জোন্স নিজেই একবার বলেছিলেন, সেই ইনিংসে ১২০ রান পার করার পর কীভাবে খেলেছিলেন, কোন শট খেলেছিলেন, কার বল খেলেছিলেন, কিছুই নাকি তাঁর পরে মনে ছিল না! কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাস জোন্সের সেই ইনিংসকে মনে রেখেছে আজও। ৩৪ বছর পরও টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে চেন্নাই টেস্টে ডিন জোন্সের সেই ইনিংস দখল করে আছে বিশেষ জায়গা।

প্রচণ্ড চাপ নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন জোন্স। হার-জিতের ব্যাপার তো ছিলই, নিজেকে প্রমাণ করার তাড়নাও ছিল তাঁর। জোন্স একবার ইএসপিএন ক্রিকেট মান্থলিকে সেই ইনিংস নিয়ে বলেছিলেন, ‘সেদিন আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম। খেলোয়াড়দের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হতো তখন। আমাদের বলা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত সেঞ্চুরি পাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ধরে নেওয়া হবে, তুমি কিছুই করতে পারনি। আমি চেন্নাই টেস্টের প্রথম দিন শেষ হওয়ার পর রাতে একেবারেই পানি খাইনি। দ্বিতীয় দিন মাঠে নেমে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও চা, কফি ছাড়া আমি খুব বেশি পানি পান করিনি। আসলে তখন আমরা পানিশূন্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতামই না। জানতাম না এটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। রানটা ১২০ পার হওয়ার পর আমার আর কিছুই মনে নেই।’

এই ইনিংস ইতিহাসে অমর করে রাখবে জোন্সকে।
সংগৃহীত ছবি

জোন্সের সেই ইনিংস বারবার ফিরে আসছে তাঁর আকস্মিক বিদায়ের দিনেও। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ারম্যান আর্ল এডিংস এক বিবৃতিতে স্মরণ করেছেন ৩৪ বছর আগে জোন্সের সেই বীরত্বগাথাকে, ‘ডিন জোন্স একটা নির্দিষ্ট প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাছে বীর। তবে ইতিহাস তাঁকে চিরদিন মনে রাখবে ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি হিসেবে। ১৯৮০ কিংবা ১৯৯০ দশকে যারা ক্রিকেটের নিয়মিত দর্শক ছিলেন তাঁরা অবশ্যই মনে করবেন জোন্সের রাজসিক চাল চলন, অফুরন্ত জীবনীশক্তি আর খেলাটার প্রতি ভালোবাসার কথা। অনেকেই তাঁকে দুর্দান্ত একজন ওয়ানডে ক্রিকেটার বলতে চাইবেন, তবে জোন্সের ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্তটি এসেছিল ১৯৮৬ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার সেই বিখ্যাত টাই টেস্টে। চেন্নাইয়ের তীব্র গরমের মধ্যে তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিয়েছিল দুর্দান্ত সেই টাই। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা ক্রিকেটারই কেবল নন, জোন্স চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর মহাকাব্যিক ২১০ রানের ইনিংসটির জন্যই।’

৩৪ বছর পর আরেক সেপ্টেম্বর ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন ‘ডিনো’র জন্য। কিন্তু সেই মনে রাখাটা হবে কষ্টের। জীবনীশক্তিতে ভরা মানুষটা যে এভাবে চলে যাবেন, সেটি যে কারও কল্পনাতেও ছিল না!