আপনার ডাক নাম ‘বিদ্যুৎ’ কেন?
ফাইল থেকে চোখটা সরিয়ে সামনে তাকালেন। মুখে এক চিলতে হাসি। বললেন, ‘জন্মের সময় নাকি বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ওটা দেখে আমার এক খালা নাম দিলেন বিদ্যুৎ। খেলোয়াড়ি জীবনে নামটা ভীষণ উপভোগ করতাম। খবরের কাগজে লেখা হতো, বিদ্যুৎ গতিতে রান করছেন বিদ্যুৎ...!’
কথা শেষ না হতেই চলে এল আরও কয়েকটি ফাইল। একের পর এক ফাইল সই করতে হচ্ছে। ব্যস্ততার ভিড়ে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে ‘দুঃখিত’ বলে আবার ফাইলে ডুব মারছেন। শাহরিয়ার হোসেনের কীই বা করার আছে! বাংলাদেশ দলের সাবেক ওপেনার এখন মস্ত বড় ব্যবসায়ী। পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্যারাডাইজ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক।
পূর্ব পুরুষের কেউ খেলোয়াড় ছিল কিনা, মনে করতে পারেন না। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনেই সবাই ব্যবসায়ী। সেই পরিবার থেকে ক্রিকেটার হয়েছেন। বাংলাদেশ দলে খেলেছেন। এর পেছনে বিরাট ভূমিকা দেখেন শুরুর গুরু জলিসুর রহমানের।
ক্রিকেট জীবনের একটা আক্ষেপ বয়ে বেড়ান আজও। ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ মেরিল ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্টে কেনিয়ার বিপক্ষে ফিরেছিলেন ৯৫ রান করে। সেঞ্চুরিটা করতে পারলেই নাম উঠে যেত ইতিহাসের পাতায়। হতে পারতেন বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। আম্পায়ারের এলবিডব্লুর সিদ্ধান্ত নিয়ে আজও সন্দিহান। এখনো তাই ভুলতে পারেন না ওই পাঁচ রানের দুঃখ, ‘দুঃখ তো আছেই। রেকর্ডটা করতে পারলে বিশাল ব্যাপার হতো। অবশ্য ওই সময় এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনি। ভেবেছি, সমস্যা নেই, আবার হবে। তবে এখন ভাবি, সেঞ্চুরিটা হলে ভালো হতো।’
ক্রিকেট অঙ্গনে শাহরিয়ারকে নিয়ে একটি কথা বেশ চালু, তিনি নাকি বোলারদের চিনতেন না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন ৩৯ রান। ইনিংসের পাঁচটি চারের তিনটিই মেরেছিলেন ওয়াকার ইউনিসের বলে। এক ওভারে দুটো চার হাঁকিয়ে সঙ্গী ব্যাটসম্যান মেহরাবকে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই বোলারটা ক্যাঠা!’
প্রসঙ্গটা তুলতেই একগাল হাসলেন, ‘আরে নাহ! তাই হয় নাকি? অনেক মুখ হয়ে গল্পটা এত ছড়িয়েছে, এখন এটাই সত্য মনে হয়। তবে এও ঠিক, প্রতিপক্ষের বোলারদের খুব বেশি খোঁজখবর করতাম না।’
২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরই তাঁর বাংলাদেশ দলের হয়ে শেষ খেলা। আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পূরণ না হওয়ার পেছনে দায়ী করেন নির্বাচকদের, “ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ রান করেও ২০০৩ অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে পারিনি। বলা হলো ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যেতে। সরাসরি ‘না’ করে দেই। এরপর সুযোগ মিলল ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কোচ ডেভ হোয়াটমোর ও ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে বিরাট ঝামেলা হলো। ওই সফরে চোটও পেয়েছিলাম। ফিজিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন বাকি ওয়ানডেগুলোতে বিশ্রামে থেকে টেস্ট খেলতে পারব। কিন্তু ফারুক ভাই কেন যেন আমার বদলি খুঁজতে উঠে পড়ে লাগলেন। যদিও এখন আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তবে তিনি নির্বাচক থাকার সময় সম্পর্কটা ভালো ছিল না। বুঝে গেলাম, ফারুক ভাই নির্বাচক থাকা অবস্থায় আমার আর খেলা হবে না।”
নিজের কোনো দায় নেই? শাহরিয়ারের পরিষ্কার জবাব, ‘না। ২০০০ থেকে ২০০৪ চার বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করেও খেলতে পারিনি। তখনই ভেবেছিলাম আর খেলব না। তবে চ্যালেঞ্জ নিলাম, জাতীয় দলে খেলে তবেই বিদায় নেব। এ জেদ নিয়েই জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেললাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও গেলাম। এরপর অবসর নিয়ে পারিবারিক ব্যবসায় চলে এলাম।’
শুরু হলো ছবি তোলার পর্ব। আলোকচিত্রী বারবার তাগিদ দিতে থাকলেন, হাসি মুখে তাকাতে। রসিকতার সুরেই বললেন, ‘ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি থাকে না। এত চাপে হাসি থাকবে কী করে?’ প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্নটা এল, কোনটি কঠিন—ইনিংসের গোড়াপত্তন, নাকি ব্যবসা? ঝটপট উত্তর, ‘ব্যবসা। দায়িত্ব, চাপ অনেক বেশি। তবে ক্রিকেটই ভালো ছিল। ম্যাচের দিন বাদে তেমন চাপ অনুভব হতো না। এখন সারা দিনই চাপ। ওই জীবনটা অন্যরকম। অনেক আনন্দের।’
ক্রিকেটের সঙ্গে জড়ানোর সময়, সুযোগ কোনোটাই নেই হাতে। তবে ক্রিকেটের প্রতি টানটা অটুট। সফল ব্যবসায়ী হলেও ক্রিকেটার পরিচয় দিতেই বেশি ভালোবাসেন। স্থানীয় ক্রিকেটের বিরাট পৃষ্ঠপোষক। আছে ক্রিকেট একাডেমিও। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা সীমাহীন বলেই অবলীলায় বলতে পারেন, ‘ব্যবসায়ী নয়, মানুষ আমাকে বাংলাদেশ দলের সাবেক ক্রিকেটার হিসেবেই চিনুক। ক্রিকেট ক্যারিয়ার যদি আবার শুরু করা যেত, সব ফেলে চলে আসতাম।’
নিজের অসম্পূর্ণ স্বপ্নটা দেখেন তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন শাহরিয়ারের মধ্যে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে দেখা দিয়েছিলেন বিদ্যুচ্চমকের মতোই। স্বপ্ন দেখেন, ছেলে যদি ক্রিকেটার হয় তবে বিদ্যুচ্চমক নয়, জ্বলবে অতি উজ্জ্বল তারা হয়ে।
আরও পড়ুন:–