সেই আক্ষেপ

>

‘এশিয়া কাপ’, শব্দজোড়ার পিঠে চড়ে আসে ‘২০১২’ও, আর এর ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে একটাই শব্দ—আক্ষেপ! মাত্র ২ রানে পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়া সেই ফাইনাল নিয়ে লিখেছেন রাজীব হাসান

অক্ষর, শব্দ, বাক্যের শক্তি নেই এই কান্নাকে বোঝায়। ফাইল ছবি
অক্ষর, শব্দ, বাক্যের শক্তি নেই এই কান্নাকে বোঝায়। ফাইল ছবি

‘যদি’র নদীতে কত ‘ইশ্’-এর ঢেউ। এক–একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে। ছলাৎ করে মাটির চাঁইয়ের মতো ভেঙে যায় মনের পাড়। চার বছর পেরিয়েও এতটুকু দুঃখ কমেনি। এখনো মনে হয় এই তো সেদিন...২০১২...২২ মার্চ...মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম...।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এরপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। সাপ-লুডুর ছক ধরে কখনো ধাঁ করে ৭ থেকে ৭০, কখনো পেল্লায় অজগরের পেট বেয়ে ৯০ থেকে ৯। ২০১৫, টাটকা সাফল্যের স্মৃতির ঠিক পরের পৃষ্ঠায় দাঁড়িয়েও সেদিনের এশিয়া কাপটির ফাইনাল ভোলা যাচ্ছে না কিছুতেই। আইজাজ চিমার করা ম্যাচের শেষ ওভার। ৬ বলে দরকার ৯। ২ বলে ৪...। শেষ দুই বল পর্যন্ত ভীষণ সম্ভব মনে হতে থাকা সমীকরণটাই মিলল না।
যেদিন মেলে না, কিছুতেই যে মেলে না!
পঞ্চম বলে রাজ্জাকের আউট, একটা উইকেটের চেয়েও বড় ক্ষতি একটা বল নষ্ট হওয়া। ইশ্, রাজ্জাক যদি বোল্ডও না হতেন, যদি হাওয়ায় ক্যাচ ভাসিয়ে দিতেন, স্ট্রাইকিং প্রান্তে হয়তো মাহমুদউল্লাহ চলে আসতে পারতেন।
১ বলে দরকার ৪। শেষ বলটা খেলতে উইকেটে এলেন শাহাদাত। যে আপনি তখন গ্যালারিতে, যে আপনি তখন বাসার টিভির সামনে, যে আপনি যখন পথে কোনো দোকানের টিভির সামনে ছোট্ট গ্যালারি হয়ে ওঠা ভিড়টায়, যে আপনি তখন অফিসের কাজকে ছুটি বলে দিয়েছেন...সবার হাতই প্রার্থনায় মগ্ন।
সেদিনের জমার টাকাই তখনো ওঠেনি বলে যার বাড়তি উদ্বেগ হওয়ার কথা, সেই রিকশা কিংবা সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বোর্ডরুমের আরামদায়ক শীতলতায় বিশাল এলইডি টিভির সামনে কেতাদুরস্ত পোশাক পরে বসে থাকা অফিসের বড় কর্তা; পরের দিনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ভুলে টিভির সামনে মূর্তিবৎ হয়ে বসে থাকা স্কুল বা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী থেকে উনুনের আঁচে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকা আটপৌরে গিন্নি...সবাই সেদিন, সেই মুহূর্তে একই বিন্দুতে।
কিন্তু না-মেলার দিনে কিছুই যে মেলে না! এত কাছে এসেও জয়টা তাই ৩ রানের দূরত্বেই। এত কাছে এসেও তাই ২ রানের পরাজয়। ২...বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক চির আক্ষেপের প্রতিশব্দ হয়ে ঢুকে গেল অদৃশ্য এক অভিধানে। ঢাউস সেই অভিধানে পাতায় পাতায় ছড়ানো শুধু দুটি শব্দ: কষ্ট, কান্না।
কাঁদছেন মুশফিক। আহা, অক্ষর, শব্দ, বাক্যের শক্তি নেই এই কান্নাকে বোঝায়। মুশফিককে বুকে আগলে রেখেছেন যে সাকিব, তাঁকে আগলে রাখবেন কে? কাঁদছেন জীবনকে সব সময়ই হাসির ছলে নেওয়ার মন্ত্রে বিশ্বাসী নাসির। কাঁদছে না আসলে কে!
যে আপনি গ্যালারিতে, পাশের জনের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে আপনার আবেগের জলে। হয়তো সেই পাশের জনটিকে আপনি চেনেনই না। কিন্তু এ এমনই এক রাত, যে রাতে কারও কাঁধে বা বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে কাঁদতে পরিচিত হতে হয় না। এক অভিন্ন আবেগে, অনুভূতিতে বাংলাদেশের প্রতিটা ক্রিকেট সমর্থক তখন পরস্পর পরস্পরের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। সবার মনেই তখন সেই ‘ইশ্’ আর ‘যদি’র উথালপাতাল ঢেউ।
শেষ বলে চার কি ক্রিকেটে কম হয়েছে! ব্যাটের এদিক-ওদিক লেগেও তো কতভাবে চার হয়! না, জাদুকরের অলৌকিক হ্যাট থেকে সেই ‘মিরাকল’ এদিন আর বের হয়নি। না-পাওয়াটাই যে ছিল এ রাতের একমাত্র পাওয়া! সেই হতশ্বাসের গুমোট বাতাস নিয়েই এদিন সবার ঘরে ফেরা। সবার কাঁধে তখন সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চেপে বসেছে রাজ্যের হতাশা। কারও কারও চোখে সর্বস্ব লুট হয়ে যাওয়ার বিহ্বলতা। কেউবা ভাষাহীন।
ভাষাহীনতাও কখনো কখনো ভীষণ রকমের শক্তিশালী ভাষা। জ্যৈষ্ঠের খররোদই যেমন জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন। আর তাই এ রাতে যে মানুষটাকে আপনি একটুও কাঁদতে দেখেননি, কে জানে, হয়তো তিনিই কেঁদেছেন সবচেয়ে বেশি। অশ্রুশূন্য কান্না!