সাবেক ‘ভালোবাসা’র প্রতি ক্ষোভ মিটিয়ে বিনয়ী ওয়ার্নার
কেপটাউন টেস্টে বল-বিকৃতিকাণ্ডে ডেভিড ওয়ার্নারের পাশেই ছিল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। কিন্তু গত মৌসুমে হঠাৎই পাল্টে যায় ছবিটা। ফর্ম একটু খারাপ হতেই ওয়ার্নারকে প্রথমে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয় হায়দরাবাদের ফ্র্যাঞ্চাইজিটা।
তারপর টানা বসিয়ে রাখা হয় ম্যাচের পর ম্যাচ। ফ্র্যাঞ্চাইজি দলটিকে হৃদয় নিংড়ে ভালোবাসলেও এমন আচরণ সহ্য করতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার। জানিয়ে দেন, সানরাইজার্সের সঙ্গে সম্পর্কের এখানেই ইতি।
স্বাভাবিকভাবেই ওয়ার্নারের মনে ক্ষোভটা থেকে যাওয়ার কথা। এবার আইপিএলে তিনি খেলছেন দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে। কালকের আগে সাত ম্যাচ খেলা ওয়ার্নারের ফর্মও বেশ ভালো। অর্ধশতক পেয়েছেন টানা তিন ম্যাচে। কিন্তু কাল প্রতিপক্ষ সানরাইজার্স ছিল বলেই কি ওয়ার্নারের ব্যাট আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল?
গত মৌসুমের সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার পর কালই প্রথম সানরাইজার্সের মুখোমুখি হওয়ায় কি ওয়ার্নারের ভেতরকার আগুনের আগ্নেয়গিরি লাভার মতো উদ্গিরণ ঘটল? না, ওয়ার্নার এ প্রশ্নের উত্তরে সুপ্ত ভিসুভিয়াস হয়েই রইলেন।
তা থাকুন, তাঁর ব্যাট কিন্তু ভিসুভিয়াস হয়ে থাকেনি। ৩ ছক্কা ও ১২ চারে ৫৮ বলে ৯২ রানের অপরাজিত ইনিংস—এমন ব্যাটিংকে আর যা-ই হোক নিরীহ বলা যায় না। সানরাইজার্স কাকে একপ্রকার গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, তা আসলে ব্যাটের ঝলকেই বুঝিয়েছেন ওয়ার্নার। আর জাত ব্যাটসম্যানরা তো জবাবটা ব্যাটেই দিয়ে থাকেন! ম্যাচে দিল্লির ২১ রানের জয় সেই জবাবেরই সিলমোহর।
ওয়ার্নারের সমর্থকেরাও জানতেন, এ ম্যাচে তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড় কিছু একটা করে বসতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর উদ্দেশে পোস্ট করেন অনেকে, ‘এখন প্রতিশোধের সময়।’ ঠাওর করতে পেরেছিলেন সানরাইজার্স সমর্থকেরা। একজন মন্তব্যও করেন, ‘একটু রয়েসয়ে, ডেভি।’ অথচ ডেভিড ওয়ার্নার নিজে খেলেছেন ভদ্রলোকের খেলা। সানরাইজার্স-ম্যাচের আগের দিন তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘অন্য সব ম্যাচের মতোই (এটা)। সাধারণ রুটিনে অনুশীলন করেই ম্যাচের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
কিন্তু ব্যাট হাতে সেই ‘ভদ্রলোক’ই মাঠে হয়ে উঠলেন নির্মম। একেকটি শট হয়ে উঠল কশাঘাতের মতো। সানরাইজার্স থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই তো বলেছিলেন, এমন আচরণ ‘হজম করা কঠিন’। এর কয়েক সপ্তাহ পর অস্ট্রেলিয়াকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতালেন, নিজে হলেন টুর্নামেন্টসেরা, তখন একবার মুখ খুলেছিলেন ওয়ার্নার, ‘বছরের পর বছর ধরে যে দলকে আপনি ভালোবেসেছেন, তেমন কোনো কারণ ছাড়াই যখন সে দল থেকে বাদ পড়বেন, কোনো কারণ ছাড়াই যখন অধিনায়কত্বও কেড়ে নেওয়া হবে, তখন কষ্ট লাগবেই।’
ওয়ার্নার তাই যতই বলুন, এটা অন্য সব ম্যাচের মতোই, তবু কেউ হয়তো তাঁর কথা বিশ্বাস করবে না। যেমন হার্শা ভোগলে। ভারতের এই জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার কাল ম্যাচে ওয়ার্নারকে বেশ খুঁচিয়েও তেমন কিছু বের করতে পারেননি। দিল্লি ওপেনারের কাছে ভোগলে একটু ঘুরিয়ে জানতে চান, ‘(কাল) আজকের ইনিংসটা কি বিশেষ কিছু ছিল?’ ওয়ার্নার এর উত্তরে যেন বল ‘লিভ’ করলেন, ‘উইকেট ব্যাট করার জন্য ভালো ছিল। এখানে তো এর আগেও রান পেয়েছি। নিজের খেলাটা খেলেছি। স্রেফ বল দেখেছি আর মেরেছি।’
কিন্তু ভোগলে নাছোড়বান্দা। আবারও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তবু আজকে একটু বেশিই উত্তেজিত মনে হয়েছে, বিশেষ করে যখন রোভম্যান পাওয়েল ছক্কা মারছিলেন, আপনি অন্য প্রান্ত থেকে চিৎকার করছিলেন। আজ কি একটু বেশি প্রেরণাদীপ্ত ছিলেন?’ ওয়ার্নার এবারও ভোগলের ‘গুগলি’ খেলার চেষ্টা করেননি, যেন স্রেফ প্যাড-আপ করলেন।
আবহাওয়ার দোহাই দিয়ে দিল্লি তারকার উত্তর, ‘মুম্বাইয়ের গরম খুব চ্যালেঞ্জিং। মনে হচ্ছিল, ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছি, আর আমার বয়সও হয়েছে, রোভি (রোভম্যান) অন্য প্রান্তে ছিল, ওর সীমানা পার করার ক্ষমতা অসাধারণ। সে ওই প্রান্তে থাকায় ভালো লেগেছে।’
বটে! ওয়ার্নারের বয়স হয়েছে! ৩৫ বছর বয়সী ওয়ার্নার নিজে যেসব শট খেলেছেন, সেসব তো তাঁর ‘বয়স’ হওয়ার দোহাইয়ের বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। আরও একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, ওয়ার্নার কতটা ভালো ‘টিমম্যান’, সেটাও বোঝা যায় এ তথ্যে—দিল্লির ইনিংসে শেষ ওভার শুরুর আগে ৯২ রানে অপরাজিত ছিলেন ওয়ার্নার।
শতকের সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু শেষ ওভারে ওয়ার্নার একটি বলও খেলেননি, নিজে স্ট্রাইকে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কিংবা এক রান নিয়ে প্রান্ত বদলের জন্য পাওয়েলকে চাপাচাপিও করেননি। উমরান মালিকের ওই ওভারে তিন চার ও এক ছক্কায় মোট ১৯ রান তুলে নেন পাওয়েল।
ওয়ার্নার যেহেতু বিনয়ের অবতার সেজেছিলেন ভোগলের কাছে, তাই অনেকে ভাবতে পারেন, উমরানের বলে ভয়ংকর গতি এবং যেহেতু তাঁর বয়স হয়েছে, আগের মতো রিফ্লেক্স নেই, তাই হয়তো শেষ ওভারে সানরাইজার্স পেসারের মুখোমুখি হতে চাননি এই অস্ট্রেলিয়ান। তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো, উমরানের প্রথম ওভার থেকে ওয়ার্নার ব্যাটে তুলেছেন ১৫ রান।
সে যা-ই হোক, ভোগলে তাঁর কাছ থেকে এই উত্তর পাওয়ার পর আর কোনো রাখঢাক রাখেননি। অনেকটা সরাসরিই প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কি তাহলে কোনো প্রেরণারই দরকার পড়েনি। না, মানে সত্যি বলতে আপনি এবং সানরাইজার্স নিয়ে যখন আমি ভাবি...?’
ওয়ার্নার এ যাত্রায় ভোগলের ‘ইয়র্কার’ ব্যাটে খেললেন, কিন্তু রক্ষণাত্মকভাবে, ‘না, আলাদা করে কোনো প্রেরণার দরকার হয়নি। অতীতে কী ঘটেছে, তা আমরা সবাই জানি। প্রতিযোগিতায় ফিরতে স্রেফ জয়ের জন্যই খেলেছি।’
কিন্তু সত্য কি আর চাপা থাকে? স্টার স্পোর্টসকে তা হাসতে হাসতে বলেছেন দিল্লির সহকারী কোচ এবং ওয়ার্নারের সাবেক জাতীয় দল সতীর্থ শেন ওয়াটসন, ‘আলাদা কিছু তো ছিলই। ডেভি নিজে তো তাতিয়ে ছিলই, দলের সবার ভেতর তা অনূদিতও করেছে। রোভম্যান গিয়ে যেমন খেলল (৩৫ বলে ৬৭), ডেভি (ওয়ার্নার) নিজের এই উদ্দীপনা দিয়েই একটা কিছু প্রমাণ করতে চেয়েছে এবং সে আজ (কাল) রাতে তা পেরেছে।’
ওয়াটসন তবু ক্রিকেটীয় ভাষায় বলেছেন, কিন্তু ধারাভাষ্যকক্ষে নির্জলা সত্যটা বলেছেন কেভিন পিটারসেন, ‘এটা ডেভিড ওয়ার্নারের ক্ষোভ মেটানোর ম্যাচ।’