সাকিবে চড়ে মিরপুরে ওয়ার্ন নামলেন যখন...
হাওয়ায় ভাসানো বলটা, পড়ল অফ স্টাম্প কি অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে। মনে হলো, একটু এগোলেই নাগাল পেয়ে যাবেন ব্যাটসম্যান। কিন্তু ধরতে গিয়ে আর পেলেন না। পড়ল একটু পেছনে, বাঁকও নিল খানিকটা; আর ব্যাট-প্যাডের মধ্যে যে আধ গজ ফারাক, তাই গলে বলটা গিয়ে ঠেকল মিডল স্টাম্পে। স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল: দিমুথ করুনারত্নে বোল্ড সাকিব আল হাসান।
আউটের ধরনটাই এমন, একঝটকায় মন চলে যায় ২০০৬-এর ডিসেম্বরে। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসও শিকার হয়েছিলেন এমনই এক ডিসমিসালের, শেন ওয়ার্নের বলে। প্রথমবারের মতো ধরাধামের কোনো বোলারের ৭০০তম উইকেটপ্রাপ্তিও ওই বলেই, তাই এর মাহাত্ম্য তাই বেড়েছে আরও একটু। হয়েছে আরও একটু স্মরণীয়।
ওই বলটা নিয়ে গর্ব যে ওয়ার্নেরও বড় কম ছিল না, সেটা বোঝা যায় তাঁর আত্মজীবনীর কয়েক পাতা উল্টালেই। দারুণ একটা সেট-আপে অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে সাজঘরে ফিরিয়েছিলেন বলেই যে এতখানি বিশেষত্ব পেয়েছে বলটা, সেটাও লিখে গিয়েছেন ওই বইতেই।
রিকি পন্টিং তাঁর হাতে বলটা যখন তুলে দেন, ইংল্যান্ড তখন ২ উইকেটে ৮২। ক্রিজে স্ট্রাউস গেড়ে বসেছেন যেন। ওয়ার্ন জানাচ্ছেন, গতি কমিয়ে-বাড়িয়ে, অ্যাঙ্গেলে হেরফের করে বিভ্রান্ত করাতেই মন ছিল শুরুতে। তবে বলকে হাওয়ায় ভাসিয়ে ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আর তা করতে গিয়েই দেখলেন, প্রথম সকালের উইকেট হলেও বল ঠিকই বাঁক নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঘাটে ১৫ বছর জলপানের যে অভিজ্ঞতা, সেটাই ওয়ার্নকে বলছিল, বল টার্ন করতে দেখলে ব্যাটসম্যানরা শুরুতেই সুইপ খেলতে চেষ্টা করেন। স্ট্রাউসও একই কাজ করেছিলেন বেশ কয়েকবার। অধিনায়ক রিকি পন্টিংকে গিয়ে ওয়ার্ন তখন জানান, ‘পান্টার, এক কাজ করি চলো। মিড-উইকেটকে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ঠেলে দিই। টপ-এজ হলে ওর কাছে যেতে পারে, এমন ভয় যেন ওর (স্ট্রাউস) মনে জাগে। এতে করে হবে কী, স্ট্রাউস বাধ্য হবে ফ্রন্ট-ফুটে এসে মিড-অন দিয়ে ড্রাইভ খেলতে।’
পরিকল্পনাটা মনে ধরেছিল পন্টিংয়েরও। বদল এল ফিল্ডিংয়ে। দায়িত্বটা এর পর থেকে বুঝে নিলেন ওয়ার্ন নিজেই। ‘হায়ার, স্লোয়ার অ্যান্ড ওয়াইডার অব অফ স্টাম্প’ লাইনে বল করে গেলেন ক্রমাগত, যেন স্ট্রাউস সুইপ খেলতে না পারেন। দুই ওভার ধরে চলল এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা। ড্রাইভ না করলে রান করার সুযোগ নেই, এই হতাশা জেঁকে বসল স্ট্রাউসের ভেতর। বাইশ গজের ওপাশ থেকে যে হতাশাটা পড়ে ফেললেন ওয়ার্নও। বুঝলেন, শিকার ধরার লগ্ন এসেছে।
পরে কী হলো, তার বিবরণ ওয়ার্নের জবানিতেই পড়তে ভালো শোনায়, ‘টপ-স্পিনিং লেগ ব্রেকটা হাত থেকে বেরোনো মাত্রই দারুণ মনে হলো। শীতল বাতাস কেটে এগোতে থাকা ফ্লাইটেড ডেলিভারিটা স্ট্রাউসকে প্রলুব্ধ করল বড়সড় একটা ড্রাইভ খেলতে। কিন্তু, বলটা ডিপ করল। তারপর মনে হলো, ক্রিজে আটকে গেল ও (স্ট্রাউস)। মিড-অন দিয়ে খেলতে চেয়েও অর্ধেক পথে থেমে গেল ব্যাট। মিস করল। আর বল গিয়ে আঘাত করল মিডল স্টাম্পের আগায়।
‘৭০০…’
***
করুনারত্নেকে করা আউটটাও সাকিবকে একই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করেছিল কি? উত্তরটা বোধ হয় আত্মজীবনীতেই দেবেন, তবে যে পরিকল্পনায় শ্রীলঙ্কান অধিনায়ককে ফেরালেন, তাতে যে ভীষণ তৃপ্ত তিনি, এমনটা তো অনুমান করে নেওয়াই যায়।
দিনের শুরুর ওভারেই এবাদত হোসেন ফিরিয়েছিলেন নাইটওয়াচম্যান কাসুন রাজিতাকে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ইনিংসের দমটাও যেন আটকে গেল পরের কয়েক ওভারের জন্য। এবাদতের সঙ্গে অপর প্রান্তে সাকিব বোলিং করলেন বেশ আঁটসাঁট। ৪৭ থেকে ৫৪—এই সাত ওভারে রান এল ৯। উইকেটও অবশ্য পড়ল না, তবে ওয়ার্নের সেই ‘রানের জন্য হাঁসফাঁস’ দশায় পাঠানোর কাজটা হলো এতে।
শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের মুক্তি মিলল পরের দুই ওভারে। এবাদতের ওভারে চার মারলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। সাকিবের করা ৫৬তম ওভারের প্রথম চার বলে এল ৭ রান। কিন্তু তখন কি আর জানার উপায় আছে, উইকেট আদায়ের রাস্তাটাও কি পরিষ্কার হলো এতে।
দৃশ্যটা অতীতে অনেকবারই দেখা গেছে। যেমন দেখা গিয়েছিল ২০১৫ সালের ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ব্লকাথন’ সিরিজে, কিংবা করোনার পর প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজে। ব্যাটসম্যান টেস্ট বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, ‘উইকেটে খুঁটি গাড়া’ শব্দবন্ধকে আক্ষরিক অর্থে নিলেও দোষের সুযোগ সামান্য, এমন অবস্থায় ব্যাটসম্যানকে হাত খোলার সুযোগ দিলেন বোলার; এমন একটা বল করলেন যে না চাইতেও ব্যাট চলে যায় বলের কাছে। বাউন্ডারি এলো, কিন্তু বারংবার অনুশীলনে যে মনকে তৈরি করে নিয়েছিলেন কেবলই ডিফেন্স করার জন্য, সেখানটায় ঘা পড়ল। নড়ে গেল মনোযোগ, এবার তার রান চাই।
***
আজও কি একই কাজটা হলো? করুনারত্নের আউট হওয়া ওভারটার ধারাবিবরণী একবার পড়ে দেখুন:
প্রথম বল: কিছুটা খাটো লেংথের ডেলিভারি। অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে আরও বেরিয়ে গেল বলে ম্যাথুস পাঞ্চ করলেন পেছনের পায়ে গিয়ে। অনেকটা দৌড়ে নুরুল হাসান সোহান দারুণ ফিল্ডিং করলেন বলে একটা রান কম হলো, নইলে চার হতো।
দ্বিতীয় বল: করুনারত্নের লেগ স্টাম্পের বাইরেই পিচ করল বলটা। করুনারত্নে সামনের পায়ে ভর করে ড্রাইভ করলেন, যদিও রান হলো না। তবে এর আগের বলটার অভিজ্ঞতায় মনে হলো, যেন টানা বল করে হাঁপিয়ে গেছেন সাকিব। বাঁ হাতটার এবার বিশ্রাম দরকার।
তৃতীয় বল: গতি কমিয়ে নামালেন ৭৯ কিমিতে। তবে আবারও একটু খাটো লেংথের ডেলিভারি। পেছনে গিয়ে কাট করলেন করুনারত্নে, তবে আবারও ফিল্ডারের হাতে।
চতুর্থ বল: চার। অনেকটা জায়গা পেয়েছিলেন করুনারত্নে, কাট করার জন্য লেংথটাও আদর্শ ছিল। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি।
পঞ্চম বল: বিভ্রম জাগানো বল? ফ্লাইট ছিল, অফ স্টাম্পের লাইনে পড়া বল। লুপ দেখে মনে হলো বাঁক নেবে বলটা। প্রথমে তাই করুনারত্নের ব্যাটটা নামল প্যাডের সঙ্গে লাগোয়া। তবে লাইন ধরে রাখল বলটা। করুনারত্নে সামলে নিলেন শেষমেশ, ডিফেন্স করলেন ব্যাটের ফেস খুলে।
***
এর আগ পর্যন্ত যা ঘটে গিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ার দেখা মিলল ওভারের শেষ বলটায়। রানের বাঁধ ভেঙেছে, ব্যাটসম্যান তাই যেকোনো সুযোগেই রান করতে চাইছেন। বুঝতে পেরে সাকিব আবারও করলেন ঝুলিয়ে দেওয়া ডেলিভারি। আগের বলটা টার্ন করেনি বলে করুনারত্নের ব্যাটটা নামল প্যাডের সঙ্গে ফাঁক রেখে। সামনের পায়ে এগোলেন, ড্রাইভও করলেন। কিন্তু সাজানো চিত্রনাট্যেও যেন খামতি রয়ে গেল কোথাও। ফলাফল তো শুরুর প্যারাতেই পড়েছেন, এত দূর পড়তে পড়তে বুঝে যাওয়ার কথা ওয়ার্নকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নামানোর কারণটাও।
এমনিতেই দুজনের যা প্রভাব, তাতে দুই দেশের ক্রিকেট দুজনকে রাজাধিরাজ বলে মেনে নিয়েছে অনেক আগেই। আজ বোধ হয় মাঠের ক্রিকেটেও ওয়ার্ন হওয়ার শখ জেগেছিল সাকিবের।
হোক না, মাত্র একটা বলের জন্যই।