সাকিবকে পছন্দ, তাই ছেলের নাম সাকিব
‘আরে, আপনারা তো আসল খবরটাই জানেন না...।’
সাকিব কথাটা বলে যেন চমকে দিতে চাইলেন। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী খবর?’ তাৎক্ষণিক উত্তর এলো, ‘ডমিনিকায় তো একটা সাকিব আল হাসান আছে...।’
বিস্ময়ের পারদ ওপরে উঠতে চাইল এবার। দ্রুত রহস্যের পর্দা সরিয়ে সেটা আর হতে দিলেন না সাকিব, ‘শোনেন, পুরো ক্যারিবিয়ানেই আমার ভক্ত অনেক (হাসি)। ডমিনিকাতে একজন আছেন যে তার বাচ্চার নাম রেখেছে আমার নামে—সাকিব আল হাসান।’
অভিভূত হওয়ার মতো এক খবরই বটে। সাকিব এরপর যখন আরও বিস্তারিত বলতে লাগলেন, তখন আফসোসটাও সীমা ছাড়াতে লাগল। আহা, এই খবর ডমিনিকাতেই কেন পেলাম না! তাহলে তো ডমিনিকার সাকিব আর তার বাবার সঙ্গে দেখা করে আসা যেত।
এদিকে সাকিব বলতে থাকেন, ‘২০০৯ সালে যখন আমরা ডমিনিকায় খেলতে গিয়েছিলাম, তখন এই ছেলের জন্ম। সেবার আমার খেলা দেখে ভদ্রলোকের এত ভালো লেগেছে যে উনি ছেলের নাম রেখে দিয়েছেন সাকিব আল হাসান (হাসি)। এবার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। দেখা করেছেন, আমার সঙ্গে ছেলের ছবি তুলেছেন। ডমিনিকাতেই মনে হয় আমার সবচেয়ে বেশি ভক্ত।’
মনে পড়ে গেল ২০০৯ সালে ডমিনিকার সেই দুই ওয়ানডের কথা। সাকিবের নেতৃত্বে দুটিতেই জিতেছিল বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই অর্ধশতক করা সাকিবের ব্যাটিংটা হয়েছিল দারুণ। দ্বিতীয় ওয়াডেতে তো ৬১ বলে ৬৫ রানের ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের সাকিবের সঙ্গে ডমিনিকার সাকিবের ছবি অনেক চেষ্টা করেও যোগাড় করা যায়নি। পাওয়া যায়নি ডমিনিকার সাকিবের বাবার নাম–ঠিকানা। বাংলাদেশের সাকিবের কাছেও সেসব কিছুই নেই, ‘আমি তো এসব কিছু রাখিনি। আমি এটাও জানি না উনি কী করেন, কোথায় থাকেন। ওরা ছবি তুলে চলে গেল। আমার খুব ভালো লেগেছে।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্ণময় ক্রিকেটটা সাকিবের এমনিতেই পছন্দ। এক সময় সব কিংবদন্তিদের বিচরণ ছিল এই দ্বীপপুঞ্জের মাঠে মাঠে। সেটি এখন অতীত, তবে ক্রিকেট নিয়ে মানুষের উম্মাদনায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। এখন তো সিপিএলের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের পুনর্জাগরণই দেখছেন তিনি। টি–টোয়েন্টি সিরিজের পর সাকিব যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গও ছিল এটাই। তাঁর দেখা সিপিএল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট। তখনই কথা প্রসঙ্গে ডমিনিকার সাকিবের ‘আসল খবর’টা দিলেন বাংলাদেশ দলের টেস্ট অধিনায়ক।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আলোড়ন তুলেছে, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজও বসে থাকেনি। ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড মাঠে নামায় তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল)। ছয় দলের টুর্নামেন্টের দারুণ ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে। ২০১২ সালে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এরপর ২০ ওভারের বিশ্বকাপ জেতে ২০১৬ সালেও। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সাত আসরে একমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজই শিরোপা ঘরে তুলেছে দুইবার।
ক্যারিবীয় ক্রিকেটে সিপিএলের সবচেয়ে বড় অবদান নতুন প্রতিভা তুলে আনা। নিকোলাস পুরান, ব্রেন্ডন কিং, রোভম্যান পাওয়েল, কাইল মায়ার্সের মতো ক্রিকেটারদের জন্ম সিপিএল থেকেই। সাকিব এই জায়গাতেই টুর্নামেন্টটির সাফল্য দেখেন বেশি, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবসময়ই টি–টোয়েন্টিতে ভালো দল। সিপিএল তাদের টি–টোয়েন্টির সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে হয়তো সবাই ভাবত যে, ওদের এই কয়টা খেলোয়াড়ই আছে, যারা ভালো টি–টোয়েন্টি খেলে। কিন্তু সিপিএল আসাতে ওরা ছয়টা দল পেল, ছয়টা অধিনায়ক ও সহ–অধিনায়ক পেল। নতুন নতুন খেলোয়াড় তো আসছেই। তারা টুর্নামেন্টটাকে কাজে লাগাতে পারছে।’
আগামী ৩১ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া পরের সিপিএলে সাকিবের নতুন দল গায়ানা আমাজন ওয়ারিয়র্স। খবরটা এরই মধ্যে চাউর হয়ে গেছে গায়ানায়।
এ ক্ষেত্রে সাকিবও উদাহরণ টানলেন পুরান–পাওয়েলদের, ‘আমি যে বছর প্রথম সিপিএল খেলি, ওই বছর সম্ভবত পুরানের অভিষেক হয়। আর ও এখন অধিনায়ক। পাওয়েলও জ্যামাইকার অধিনায়ক হয়ে গেছে। অথচ যখন আমি ওই দলে খেলি, ও তখন শুধুই একজন খেলোয়াড়। সিপিএল থেকে ওঠে আসারাই কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি–টোয়েন্টি দলের শক্তি।’
একই কথা বলেছেন সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার ও এই সিরিজে ধারাভাষ্যকার প্যানেলে থাকা ড্যারেন গঙ্গা, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বাইরে এখন যত ক্রিকেটার আছে, সবাইকেই বলতে পারেন সিপিএলের সৃষ্টি। টুর্নামেন্টটা টি–টোয়েন্টি খেলোয়াড়দের স্বপ্ন দেখাতে পারছে। সিপিএল শুরুর পর থেকে এই অঞ্চলের তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্রিকেট জ্ঞানের আদান–প্রদান, বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেকে প্রকাশ করার সামর্থ্য, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও নেতৃত্বগুণ প্রবলভাবে বাড়ছে।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে পুরানের সঙ্গে শিমরন হেটমায়ারের কথাও বলেছেন গঙ্গা, ‘পুরান মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিপিএলে খেলেছে, এই টুর্নামেন্টে ও-ই সবচেয়ে কনিষ্ঠ ক্রিকেটার। ২০১৬ যুব বিশ্বকাপ জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব–১৯ দলের অধিনায়ক শিমরণ হেটমায়ারও পরে সিপিএলে এসেছে। টি–টোয়েন্টিতে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে দুজনই।’
সাকিব সিপিএলে এখন পর্যন্ত খেলেছেন দুটি দলের হয়ে— জ্যামাইকা তালওয়াহস আর বারবাডোজ ট্রাইডেন্টস। আগামী ৩১ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া পরের আসরে তাঁর নতুন দল গায়ানা আমাজন ওয়ারিয়র্স। খবরটা এরই মধ্যে চাউর হয়ে গেছে গায়ানায়। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে এখানে আসার পর গায়ানার লোকজন তাঁকে নাকি বলে দিয়েছেন, ‘এবার কিন্তু আমাদের চ্যাম্পিয়ন করাতে হবে।’
সিপিএলের সবচেয়ে বড় সাফল্যের কথা তো সাকিব বললেনই, এর বাইরে টুর্নামেন্টে নিজেদের দল নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর উম্মাদনাও তাঁকে দারুণ টানে, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষ সিপিএল ভীষণ উপভোগ করে। খেলা শুরু হলে এরা এটা নিয়েই মেতে থাকে। আমি দুইটা দলে খেলেই খুব আনন্দ পেয়েছি। গায়ানার মানুষ তো এখনই বলাবলি শুরু করেছে তাদের ট্রফি এনে দিতে হবে।’
কৃষির পাশাপাশি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে আয়ের বড় উৎস পর্যটন। সিপিএল তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে ছড়িয়ে দিয়েছে ‘ক্রীড়া পর্যটনে’র ধারণা। ব্যবসা–বাণিজ্যেও এই টুর্নামেন্ট খুলে দিচ্ছে নতুন সব জানালা। ঝকমারি টি–টোয়েন্টির ঝলকানিতে নিজেদের পণ্যের প্রচার বাড়াচ্ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। আসলে বাণিজ্যিকভাবে সফল না হলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর টিকে থাকাই দায় হয়ে যায় এ ধরনের টুর্নামেন্টে। আর ফ্র্যাঞ্চাইজি না থাকলে টুর্নামেন্টই বা টিকবে কি করে!
সাকিবের পর্যবেক্ষণ, ভালো ‘বিজনেস মডেল’–এর কারণেই ক্রমশ ওপরের দিকে যাচ্ছে সিপিএলের মান, ‘ব্যবসার দিক থেকে ওরা সাফল্য পাচ্ছে। এখানে এখন আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকরা এসেছেন, আমেরিকার কিছু মানুষও এসেছেন। স্বাভাবিকভাবে ওদের ব্যবসা ভালোর দিকে। বিজনেস মডেল ভালো না থাকলে টিকে থাকা কষ্ট এসব টুর্নামেন্টের।’
জ্যামাইকা তালওয়াহস ও সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস প্যাট্রিয়টসের হয়ে সিপিএলের উম্মাদনায় সিক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছে মাহমুদউল্লাহরও। সাকিবের মতো বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি অধিনায়কেরও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ক্রিকেটটা বেশ পছন্দ। সেদিন জর্জটাউনের এক রেস্তোঁরায় গল্প করতে করতে মাহমুদউল্লাহ বলছিলেন, ‘আমি দুই মৌসুম খেলে খুবই উপভোগ করেছি সিপিএল। কোভিডের মধ্যে সর্বশেষ যেটা হলো সেটাতেও খেলার ইচ্ছা ছিল, আমার কাছে প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু করোনার কারণে পরিবার থেকে চায়নি আমি এত দূরে এসে খেলি। সে জন্য আর আসা হয়নি।’
সিপিএল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নতুন খেলোয়াড় এনে দিচ্ছে, নিজেদের দেশের দল নিয়ে মানুষের উম্মাদনা—এসবের বাইরে মাহমুদউল্লাহর চোখ আটকে যায় টুর্নামেন্টটাকে যে কোনো মূল্যে মাঠে রাখার চেষ্টা দেখে, ‘শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্ট কোনো বছর বন্ধ থাকেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড সিপিএল নিয়মিত মাঠে রাখতে পারছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। গত দুই বছর করোনার মধ্যেও তারা টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে।’
সাকিব–মাহমুদউল্লাহর মুখে সিপিএলের প্রশংসা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল, বাংলাদেশেও তো এরকম একটা টুর্নামেন্ট আছে। নাম তার বিপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সৌরজগতে আইপিএলের পর দ্বিতীয় বড় নক্ষত্রই নাকি এটি। কিন্তু বিপিএলের সঙ্গে কেন জানি ‘বিজনেস মডেল’, নিয়মিত খেলা হওয়া, নতুন খেলোয়াড় উঠে আসা—এই ব্যাপারগুলো যায় না। কেউ কি বলতে পারেন কেন?