সাকিবের অধিনায়কত্ব নিয়ে আলোচনার খুব বেশি কিছু নেই। আমার কথাই ধরুন। প্রথমবার অধিনায়কত্বের সময় আমি যে রকম পরিণত ছিলাম, দ্বিতীয়বার আরও বেশি ছিলাম, তৃতীয়বার কিন্তু আরও ভিন্নভাবে এসেছি। সাকিবের ক্ষেত্রেও নিশ্চয় তা–ই হবে।
সাকিবের জন্য এবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ টেস্ট দলকে। অন্যভাবে দেখলে এখানে তার সম্ভাবনাও আকাশচুম্বী। আমাদের হাতে একমাত্র সাকিবই আছে, যার নেতৃত্বে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দিন বদলাতে পারে। এই সংস্করণে ভালো করতে হলে দলের ভার সাকিবের মতো একজনের কাছেই থাকা উচিত, পুরো বিশ্ব যাকে গোনায় ধরে। আমি এতটা আশা করছি না যে সাকিব বাংলাদেশকে র্যাঙ্কিংয়ের ৪-৫–এ নিয়ে যাবে। তবে আমার বিশ্বাস, সে অন্তত টেস্টে আমাদের উন্নতির গ্রাফটাকে ওপরের দিকে নিতে পারবে। সেদিক দিয়ে বলব, টেস্ট নেতৃত্বের জন্য বিসিবি সেরা মানুষকেই বেছে নিয়েছে।
অধিনায়ক সাকিবের আরও একটা চ্যালেঞ্জ তার বয়স। আমার সামান্য হলেও ভয় আছে, এই বয়সে ওর অধিনায়কত্বে আসায় ২০২৩ বিশ্বকাপে না আমরা বড় বিপর্যয়ে পড়ি! আগামী বিশ্বকাপে আমাদের ভালো করার সুযোগ আছে এবং সেখানে আমরা পুরোপুরি সুস্থ সাকিবকে চাই। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে এই বয়সে যে চাপটা তাকে নিতে হবে, আমার একটাই চিন্তা, এত চাপ নিয়ে বিশ্বকাপের আগে সাকিব না আবার ভেঙে পড়ে! সে টেস্ট খেলবে এবং টেস্ট দলের নেতৃত্ব দেবে, ওয়ানডে খেলবে, টি-টোয়েন্টি খেলবে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটও খেলবে। সঙ্গে ভ্রমণক্লান্তি তো থাকবেই। বয়স ৩৫ পেরিয়ে যাওয়ার পর এত ধকল সাকিব কীভাবে সামলাবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। তারপরও সাকিবকে ধন্যবাদ, এসব মাথায় রেখেও সে নেতৃত্ব নিয়েছে।
সাকিবকে টেস্ট অধিনায়ক করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে—সাকিব নিয়মিত টেস্ট খেলবে তো? মাঝে সে টেস্টে বিরতি দিয়ে খেলেছে। আমার দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটা খুব ভালো ছিল। কিন্তু অধিনায়ক হওয়ার পর সাকিবের সেই সুযোগ কমে যাবে। ওকে যুদ্ধ করতে হবে শরীরের সঙ্গে, মনের সঙ্গে; সঙ্গে টেস্টে বাংলাদেশকে সুদিন দেখানোর চ্যালেঞ্জ—এই জায়গাগুলোতে ভালো সমন্বয় করতে পারলে আমার মনে হয় না ভয়ের কিছু আছে। আমাদের দল তো এখন টেস্টে এমনিতেই ভালো করছে না। এখান থেকে কেবল উন্নতিরই সুযোগ আছে এবং সেটা সাকিবের নেতৃত্বেই সম্ভব।
অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের সবচেয়ে বড় গুণ তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। মাঠে একজন অধিনায়ক সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধিতে দল পরিচালনা করে। এই জায়গায় ব্যর্থ হলে কোচরাও পাশে থাকে না। টিম ম্যানেজমেন্ট পাশে থাকে না। সেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাকিবের বিকল্প কেউ নেই। এই যুগের ক্রিকেটে কোচরা তো কেউ মরিনিও হতে চায়, কেউ চায় গার্দিওলা হতে। তারা নিজেদের ফুটবল কোচ ভাবে। কিন্তু ফুটবল কোচ-নির্ভর খেলা হলেও ক্রিকেট পুরোপুরিই অধিনায়ক-নির্ভর খেলা। অধিনায়ককে দল নির্বাচন, একাদশ গঠনে প্রাধান্য না দিলে তার কাছে জবাবদিহিও চাওয়া ঠিক নয়। আশা করি, সাকিবের ক্ষেত্রে সেটা হবে না, যেটা মুমিনুলের ক্ষেত্রে হয়েছে। অবশ্য কারও সে রকম ইচ্ছা হলেও সাকিবের ক্ষেত্রে হয়তো বলার সাহস পাবে না।
ক্যারিয়ারজুড়েই সাকিবকে অনেক বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে মানুষের আলোচনা-সমালোচনা সাকিব কতটা নিচ্ছে বা কীভাবে নিচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার ধারণা, খেলোয়াড় সাকিবকে তো নয়ই, অধিনায়ক সাকিবকেও এসব স্পর্শ করবে না।
আপনি যখন শীর্ষ পর্যায়ে থাকবেন, আপনাকে নিয়ে অনেক রকম মন্তব্যই আসতে পারে। ভালো কথা হবে, খারাপ কথা হবে। এসব ক্ষেত্রে সাকিব ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই ভেঙে পড়ে। তার মানে এই নয় যে সাকিবের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয় না। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সে হয়তো জন্মসূত্রেই পেয়েছে।
টেস্ট দলে লিটনকে সাকিবের ডেপুটি করাটাও ভালো সিদ্ধান্ত। আমি তো বলি, সবচেয়ে জরুরি এটাই ছিল। অধিনায়ক যদি চোটে পড়ে মাঠ থেকে উঠে যায়, কোচ তো কাউকে গিয়ে বলে আসবে না, ‘এই, তুমি অধিনায়কত্ব করো।’ তখন দলের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। একজনকে দায়িত্ব দিলে আরেকজন ভাবতে পারে, ‘আমিও তো করতে পারতাম!’
কিন্তু বোর্ড থেকে যখন ঘোষণা হয়ে যায়—লিটন টেস্টের সহ–অধিনায়ক বা অমুক ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির সহ–অধিনায়ক; অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার ওপর দায়িত্ব চলে আসে। ভুল–বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে না। আর সহ–অধিনায়কেরও একটা মানসিক প্রস্তুতি লাগে। ধরুন সাকিব কোনো কারণে টেস্টের মাঝে ১০ ওভার বিশ্রাম নেবে, সহ–অধিনায়ক হিসেবে লিটনের শেখাটা কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয়ে যাবে। আরও ভালো হবে যদি ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি দলেও সহ–অধিনায়ক রাখা হয়।
একটা কথা না বললেই নয়। টেস্ট ক্রিকেটে আমরা হয়তো আরও আগে আরেকটু ভালো অবস্থানে যেতে পারতাম। কিন্তু একটা ভুল ঢাকতে গিয়ে আরও কয়েকটা ভুল করায় সেটা আর হয়নি। টেস্টে আমরা যখন ভালো জায়গায় যাচ্ছিলাম, ওই সময় মুশফিককে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোটা ভুল ছিল বলেই আমি মনে করি।
তারপরও বিসিবিকে ধন্যবাদ যে অবশেষে তারা সাকিবকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অধিনায়কত্বের জন্য রাজি করিয়ে সাকিবকে তিন সংস্করণে খেলাতে পারা, সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে এই ঝুঁকি নেওয়া—কাজটা কঠিন অবশ্যই। সাকিবকে আগাম অভিনন্দন, এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিশ্চয়ই সে সফল হবে।