একদম ‘হবেই’ বলে কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে অনেকের হয়। জো রুটের পর্যন্ত হয়েছিল। তখন মন-মাথার ঠিক থাকে না। রাতে ঘুমটা পর্যন্ত আসে না। পরিবার ভাবে, আচমকাই এমন খিটখিটে হয়ে গেল কেন দিব্যি সুস্থ মানুষটা? ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সটা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। একটা প্রশ্নেরও সূত্র, ‘আমার তো হচ্ছে, দলের কেন হচ্ছে না?’
দিনের পর দিন দল হেরে গেলে, এমনটাই অবশ্য হওয়ার কথা। এ কারণেই তো যেকোনো কাজ করতে গেলে ‘গোল্ডিলকস রুল’ বলে একটা নিয়ম মানতে বলেন মনস্তাত্ত্বিকেরা। সব সময়ই নাকি এমন কাজ করা উচিত, যা সামর্থ্যের একেবারে বাইরেও নয়, আবার যোগ্যতার চেয়ে কমও নয়। কখনো সফল হবেন, কখনো ব্যর্থ; ‘দ্য থ্রি বিয়ার্স’ গল্পটা পড়ে থাকলে আপনিও জানেন, কাজ করার সত্যিকারের প্রেষণা তখনই আসে।
তাই যদি হবে, তো সাকিব আল হাসান টেস্ট খেলতে আগ্রহ না পেলে তাঁর ওপর দায় চাপানোর সুযোগ যৎকিঞ্চিৎ। দলের জয়ই তো ক্রিকেটারদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা, ৬২ টেস্টের ক্যারিয়ারে সাকিব সেই যক্ষের ধনের দেখা পেয়েছেন মোটে ১২ বার। তাঁর পরিসংখ্যান ঈর্ষার কারণ হবে ক্রিকেটাঙ্গনের অনেক রথী-মহারথীরই।
চট্টগ্রামে ৩৬ রানে ৭ উইকেট আছে তাঁর, দক্ষিণ আফ্রিকায় দুবার পেয়েছেন ৫ উইকেট; ওয়েলিংটনে ডাবল সেঞ্চুরি, মিরপুরে একই টেস্টে ১৪৪ ও ৬ উইকেট…এমন অনেক কীর্তিই গড়েছেন গেল দেড় দশকে। তবু সাকিবের ঝুলিতে এই মণি-মুক্তাগুলো ম্লান হয়েই জ্বলছে। এমন পারফরম্যান্স সত্ত্বেও প্রতিবারই তো দল হেরেছে!
অ্যান্টিগা টেস্টও আরও একবার হতাশায় পোড়াল সাকিবকে। না, এই টেস্টের পুরোটা সাকিবময় ছিল না, তবু দলের সেরা পারফর্মার বললে তাঁর নামটাই লিখতে হবে সবার আগে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে খেলতে গেলেন সবার শেষে, প্রস্তুতি ম্যাচেও নামলেন না। অথচ, ম্যাচে সবচেয়ে সাবলীল তিনিই। হাফসেঞ্চুরি করলেন দুই ইনিংসেই, বোলিংয়েও ছাপ রাখলেন বুদ্ধিদীপ্ততার। তবু অধিনায়কত্বের তৃতীয় ইনিংসের মুখবন্ধ লেখা হলো পরাজয়েই।
সবখানেই যেহেতু পারফরম্যান্সের চূড়ায় থাকতে হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটটা সাকিবের কাছে চাইছেও খুব বেশি। অবশ্য ক্যারিয়ারের গোড়া থেকেই এই চাহিদার সঙ্গে চেনা-জানা তাঁর। এই চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই ২০১২ সালে স্পিনারদের জন্য বিরল (সাধারণত পেসাররাই শিকার হন ওই ইনজুরির) এক চোটে পড়ে মাঠের বাইরে গিয়েছিলেন দুই মাসের জন্য।
তখন জানা গিয়েছিল, মাত্রাতিরিক্ত বল করাই ওই চোটের নেপথ্য কারণ। বাংলাদেশের টেস্ট বোলিংয়ে তিনিই তখন সবেধন নীলমণি। মোহাম্মদ রফিক অবসর নেওয়ার পর তিন সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়ে তত দিনে বল করেছিলেন ১০৫১.৩ ওভার, বাংলাদেশ দলে নিকটতম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বোলারের চেয়ে ৫৮২.১ ওভার বেশি।
এখন অবশ্য বোলিংয়ে নিজেকে ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ মনে করার কোনো কারণই নেই সাকিবের। এই বাংলাদেশ পেসারই খেলায় তিনজন; তাঁরা উজাড় করেই দেন নিজেদের, বাংলাদেশকে ম্যাচ রাখেন। তবু সাকিবের ওপর থেকে বোলিংয়ের ভার পুরোপুরি কমল কই? ২০২২ সালে তিন টেস্ট খেলেই বল করে ফেলেছেন ১২৮.১ ওভার। সংখ্যাটা আরও ভয়ংকর, কারণ, দলের ব্যাটসম্যানদের ভগ্নদশা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগও করে দিচ্ছে না তাঁকে।
সর্বশেষ ১৭ ইনিংসের মাঝে বাংলাদেশ ৫০ রানের কমে ৪ উইকেট হারিয়েছে ১০ বার। সাকিব যে চার টেস্ট খেলেছেন পাকিস্তান সিরিজ থেকে, এর মধ্যে ৫ বার ১৫ ওভারের মাঝে ব্যাট হাতে নামতে হয়েছে তাঁকে। বয়স পেরিয়েছে ৩৫-এর কোটা, শরীরও বেগড়বাই করছে মাঝেসাঝেই। অ্যান্টিগা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই অন্তত তিনবার পিঠের ব্যথায় ফিজিওর শুশ্রূষা নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
শরীর-মনকে এমনভাবে নিংড়ে দিয়েও লাভ হচ্ছে না, দল যেই তিমিরে সেই তিমিরেই। সাকিব তবু টেস্ট খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন, যদি দলকে ঘিরে নতুন ভোরের স্বপ্ন খেলা করত তাঁর চোখেমুখে। এই সাকিব কি সেই স্বপ্নটাও দেখতে পারেন?
২০১০ সালের নভেম্বর। সাকিব আল হাসান তখন টেস্ট অধিনায়ক। টেস্ট আঙিনায় বাংলাদেশের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে প্রথম আলো থেকে ছাপানো হবে বিশেষ ম্যাগাজিন, সাক্ষাৎকারের টেবিলে বসানো হলো সাকিবকে। সেখানেই তিনি জানালেন, পরের দশক শেষ হতে হতে র্যাঙ্কিংয়ের পাঁচে তুলে আনতে চান বাংলাদেশকে।
কাট টু ২০২২-এর অ্যান্টিগা। বাংলাদেশ ৭ উইকেটে টেস্ট হেরেছে একটু আগেই। সাকিব এবারও অধিনায়কের চেয়ারে। স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকেরা জানতে চাইলেন টেস্ট হারের পরের অনুভূতি। সাকিবের উত্তরটা একটু অবাক করা, ‘হয়তো আরেকটু বেটার করতে পারতাম। (তবে) এক্সপেকটেশন এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল, তা বলব না।’
বাস্তবতাই বোধ হয় এমন, এই বাংলাদেশ সাকিবকে স্বপ্নও দেখাতে পারে না।