সবচেয়ে সৌভাগ্যবান এক হতভাগার গল্প
বাংলাদেশ দল যখন জেতে, তখন আপনি কী করেন? আর সেই জয়টা যদি হয় বড় দলগুলোর বিপক্ষে, বড় কোনো মঞ্চে? শেষ ওভারে নাটকীয় কোনো জয়! আচ্ছা, বাংলাদেশ দল যখন হেরে যায়, তখন আপনি কী করেন? বড় কোনো মঞ্চেই, টুর্নামেন্টের ফাইনালে, শেষ ওভারে!
উত্তেজনায় থরথর কাঁপতে থাকেন, যেন একটা পুকুরে ক্রমাগত ঢিল ছুড়ছে কেউ। আপনার শরীরের ভেতর দিয়ে অ্যাড্রিনালিনের তুফান ছোটে। জিতে গেলে আনন্দে লাফাতে থাকেন, ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক ছেলে কি মেয়েটা; কিংবা অফিসের মুখচোরা কর্মীটাও চিৎকার করে ওঠে। কেউ আনন্দে কেঁদে দেন! কিছু কিছু কান্না যে কত সুখের, বোঝা যায়। কেউ কেউ কাঁদেন হেরে গেলেও। বাকিরা হতাশায় মুষড়ে পড়েন।
আর এখন তো সবার আগে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার ইঁদুর দৌড় আছে। সেখানে তো লিখতে হবে কোনো পোস্ট, কিংবা দিতে হবে ছবি! আগে হরহামেশা হতো, এখন একটু কমেছে; রাস্তায় রাস্তায় বিজয় মিছিল!
এবার কিছু মানুষের কথা শুনুন। আপনার মতো তাঁদেরও ইচ্ছা করে আবেগে ভেসে যেতে। ইচ্ছা করে চিৎকার করে উঠতে। নাটকীয় কোনো জয়ে কিংবা পরাজয়ে সারা দেশ যখন আনন্দে মাতোয়ারা কিংবা শোকে বিহ্বল; সেই সময় সেই মানুষগুলো ঠকঠক ঠকঠক শব্দ তুলে যায়। ওরা যে কলমের কাঠঠোকরা। শব্দ খুঁটে খুঁটে বাক্য সাজায়। তাই দিয়ে তৈরি হয় খবর। ওরা ক্রীড়া সাংবাদিক, পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হতভাগা মানুষের দল!
সৌভাগ্যবান, কারণ মাঠের সবচেয়ে ভালো জায়গায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ওঁরা খেলা দেখে। বোর্ড সভাপতিও হিংসা করতে পারেন, এমন যত্নআত্তিও পায়। সেটিও বিনে পয়সায়। অফিসের সহকর্মী সাংবাদিকেরা কৌতুক করেন, ‘কপাল ভাই আপনাদের, এত আরাম করে ফ্রিতে খেলা দেখেন, দেশ-বিদেশ ঘোরেন...এর জন্য আবার বেতনও পান!’ কথাটা কিছুটা সত্যি তো বটেই!
কিন্তু এই মানুষগুলো দুর্ভাগাও। হিপোক্রেটিক ওথ নেওয়ার কেতা হয়তো নেই, তবু সাংবাদিকেরা এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন, আবেগকে একপাশে সরিয়ে রাখতে হবে। সব সময় কি আর তা পারা যায়? বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ শব্দটা জড়িয়ে থাকে! দলের জয়কে তাই কেউ লেখে না ক্রিকেট বা ফুটবল দলের জয়; লেখে বাংলাদেশেরই জয়!
হেরে গেলে তাই আর সব সমর্থকের মতো সাংবাদিকের নিজেদেরও পরাজয়ের গ্লানি ভর করে। আঙুলগুলো অবশ হয়ে যেতে চায়। তবু কলমের কাঠঠোকরারা খটখট করে লিখে চলেন। তার যে জয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার ফুরসত নেই; হেরে গেলেও নেই দুঃখ বিলাসের সময়।
ফেসবুকেই বা আবেগ দেখানোর সময় কই? অফিস দিচ্ছে তাড়া, লেখা দাও, লেখা দাও! বেলা যে যায়! আর অনলাইন সাংবাদিকদের তো আরেক জ্বালা। প্রতিটা মিনিট তাদের জন্য ডেডলাইন। তবু বলতেই পারেন, এত কাঁদুনি কেন গাইছ বাছা! কেন?
ঘাড় গুঁজে দিন লিখতে লিখতে, ঘাড় গুঁজে রাত লিখতে লিখতে...যখন আমার লিখবার হাত অসাড় হলো। মনে পড়ল, এরই ভেতরে মুছে যাওয়া দিন কি রাতের মধ্যে প্রিয় সন্তানের জন্মদিন গেছে, কিংবা বিয়ে বার্ষিকী....লিখতে ইচ্ছে করে না, তবু তো সত্যি, প্রেসবক্সে বসেই অনেকে কত কত দুঃসংবাদ শুনেছেন প্রিয়জন-পরিবারের।
সেই জাহাজ যুগের সময় ক্রিকেটাররা লম্বা সফরে বের হতেন বলে, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড যেতেই হয়তো মাসকাবার, ক্রিকেটারদের স্ত্রীদের বলা হতো ক্রিকেট উইডো। এই যুগে এসে ক্রিকেট সাংবাদিকদের জন্যও কথাটা খাটে। নিজের পরিবার থেকে দূরে দূরে কাটিয়ে এই হতভাগারা সতীর্থ-সহকর্মীদেরই পরিবার বানিয়ে নেন। নিজ সন্তানের জন্মদিনের কেকের ছবিটা আসে ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে। আর নিজের জন্মদিনের কেকটা কাটতে হয় প্রেসবক্সে বসে। মাত্র দুদিন আগে চট্টগ্রামের প্রেসবক্সে যেমন কাটা হলো একজনের কেক।
এমন নয়, এই গল্পটা নতুন। এ-ই তো জীবন। পুরোনো গল্পটা মনে করিয়ে দেওয়ার দোষ দেওয়া উচিত ছবিতে যে জিম্বাবুয়ের ভদ্রলোকটিকে দেখছেন, তাঁকে। প্রিসিভাল সিজারা নামের এই সাংবাদিক পুরো প্রেসবক্সে একমাত্র জিম্বাবুইয়ান! ওদিকে ২০০ বাংলাদেশি সাংবাদিক! জিমপ্রেসের ক্রীড়া সাংবাদিক জিম্বাবুয়ের শুধু তিনটি ওয়ানডে কাভার করতেই কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তবু ঢাকার ম্যাচটি দেখার সৌভাগ্য হয়নি ভ্রমণ জটিলতায়।
চট্টগ্রামের দুই ম্যাচ হতে না হতেই হারারে থেকে ভাইবারে টুং: শিগগিরই ফেরো, টেস্ট করার আর দরকার নেই। অন্য কাজ আছে! বেচারা ম্যাচের নোট নিতে নিতে ফ্লাইট খুঁজছেন। টেস্টটা করে যেতে পারলে তাঁর ভালো লাগত। এই কদিনে দেশটাকে পছন্দ হয়েছে। বেশ গরম, তবে তার চেয়ে যে বেশি উষ্ণ মানুষের ভালোবাসা! বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা বারবার এসে তাঁর খোঁজখবর নিচ্ছে দেখে একটু যেন অবাকই হয়েছেন!
সিজারার কাছে যেতে হয়েছিল মূলত এই কথা জানতে, কী হলো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের! যে দেশের ক্রিকেটীয় উত্থান অনেককে চমকে দিয়েছিল, তারাই কিনা আগামী বিশ্বকাপে থাকবে না! সিজারা ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথাই বললেন। বলতে বলতে এক সময় মনে হলো, গলাটা একটু আবেগে কেঁপে যাচ্ছে। নিজে ছোটবেলা থেকেই খেলা পাগল। এক সময় খেলতেনও। নিজের স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য খেলা নিয়ে কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। লে-খা আর খে-লা এই দুইয়ের মধ্যে এত কাছের এক সম্পর্ক দেখে, সেই যে নেশায় পড়ে গেলেন, ৯ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে।
সিজারার আবেগী গলাটাই বাধ্য করল তাঁর দিকে আরেকবার ভালো করে তাকাতে। বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং দেশের আর্থিক উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। বাংলাদেশের নতুন বাংলাদেশ হয়ে ওঠার সবচেয়ে সফল ব্র্যান্ড হয়তো আমাদের ক্রিকেট। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এখনকার দশার সঙ্গে মিলে যায় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা। কে জানে, হয়তো টেস্ট কাভার না করে ফিরে যাওয়ার কারণও অর্থনৈতিক! তা তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না। করলে মানুষটির যে অসম্মান হয়।
সিজারার দিকে ভালো করে তাকাতে নজরে পড়ল পরনের পোশাক। প্রতিদিন জিম্বাবুয়ের জার্সি পরে আসছেন। বারবার আড়াল করার চেষ্টা করছেন, জিম্বাবুয়ের ব্যর্থতা। আশ্বাস দিচ্ছেন, একটা জয় পেলেই দলটার চেহারা বদলে যাবে। তখন মনে পড়ল, এই বাংলাদেশ দলই যখন একের পর এক ম্যাচ হারত, আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকেরা কী করতেন? টানা ৪৭ ওয়ানডে না জেতার বিশ্ব রেকর্ড আছে বাংলাদেশের। দুই দিনে টেস্ট হেরে যাওয়ার তত্ত্ব শুনতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তখন কী করে কলম চলত আমাদের সেই সব অগ্রজ ক্রিকেট লেখকদের?
তখন মনে হলো, জিম্বাবুয়ের গল্প আরেক দিন হবে। আজ সিজারার গল্পটাই হোক। আচ্ছা সিজারা, এই যে জিম্বাবুয়ে একের পর এক ম্যাচ হারছে? তোমার ক্লান্ত লাগে না লিখতে? একের পর এক পরাজয়ের গল্প লিখতে! হিপোক্রেটিক ওথ নেওয়া সিজারা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললেন, ‘আমিও তো মানুষ! আর সবার মতো আমারও তো আবেগ আছে!’
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হেরে যাওয়ার পর হ্যামিল্টন মাসাকাদজা যে ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনের একটির রেকর্ড গড়লেন, এর কারণ কিছুটা সিজারারও। দুই কি তিন প্রশ্নে শেষ হয়ে যাওয়া সেই সংবাদ সম্মেলনে সিজারা নিজেই কিছু জানতে চাইলেন না নিজ দেশের অধিনায়কের কাছে। কোনো কৈফিয়ত চাওয়া নেই!
তখন কেন জানি মনে হলো, টানা ৪৭ ম্যাচে জয়ের দেখা না পাওয়ার ক্লান্তি থেকে মুক্তি বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেট সাংবাদিকেরা পেয়েছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই। এ বছর ১৯টি ওয়ানডে হেরে যাওয়া জিম্বাবুয়ে, টানা ১২টি পরাজয়ের মধ্যে থাকা জিম্বাবুয়ে বছরের শেষ ওয়ানডেটা জয় দিয়ে শেষ করলে খুব কি ক্ষতি হবে?
জিম্বাবুয়ে ২৮৭ রানের লক্ষ্য দেওয়ার পর, বাংলাদেশ প্রথম বলেই উইকেট হারানোর পর, এ বেলা সত্যিটাই স্বীকার করে নেওয়া যায়, ভালো লাগেনি, খারাপও লাগেনি। ঠিক তখনই এই লেখা শুরু করার পর লেখার শেষে এসে স্কোরবোর্ডে তাকিয়ে দেখি, বাংলাদেশ ওই ১ উইকেটেই ৯৫ রান তুলেও ফেলেছে! আশ্চর্য তো, কখন উঠল এতগুলো রান?
এ-ই তো হতভাগ্য সাংবাদিক জীবন। মাঠের সবচেয়ে ভালো ‘ভিউ’ পাওয়া যায় এমন আসনে বসেও শেষ পর্যন্ত খেলাটাও ঠিকমতো তো দেখা হয় না!