সপ্তম টি-টোয়েন্টিতেই ‘সপ্তমে’
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের গল্পের নায়ক ছিলেন অধিনায়ক আকবর আলী। ওপেনার পারভেজ হোসেনের নামটা খুব একটা উচ্চারিত হয়নি সেদিন। কিন্তু পারভেজ ব্যাটিংয়ে না নামলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জেতাই কঠিন হতো।
ভারতের লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণু তাঁর গুগলিতে বাংলাদেশি ডানহাতিদের ডিফেন্স কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে চোটে পড়া বাঁহাতি পারভেজ মাঝের ওভারে ফিরে সামাল দেন বিষ্ণুকে। যোগ করেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ রান।
চলমান বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে বিশ্বকাপজয়ী দলের বাকি সতীর্থদের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল সেই পারভেজই। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে করেছেন ৪২ বলে ৫১ রান। কাল সমান বল খেলে করলেন ১০০।
অবিশ্বাস্য ম্যাচ জেতানো ইনিংসে যেন টুর্নামেন্টেরই নায়ক বনে গেলেন তিনি!ভাঙলেন বাংলাদেশিদের মধ্যে দ্রুততম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির রেকর্ড। নিজ দল ফরচুন বরিশালকে টিকিয়ে রাখলেন টুর্নামেন্টে। কিন্তু ক্যারিয়ারের মাত্র সপ্তম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই এত কিছু!
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের যেখানে টি-টোয়েন্টির গতি বুঝতেই অনেকটা সময় চলে যায়, পারভেজ যেন সেখানে প্রবল ব্যতিক্রম।
বিকেএসপির ছাত্র থাকা অবস্থায় চিত্তবিনোদনের জন্য পারভেজদের মাঝেমধ্যে টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ দেওয়া হতো। নইলে বিকেএসপির ক্রিকেট শিক্ষাটা মূলত দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট আর ওয়ানডে দিয়েই হতো। তো বিনোদনের ক্রিকেট খেলতে খেলতেই পারভেজ পছন্দের সংস্করণ হিসেবে বেছে নেন টি-টোয়েন্টিকে।
পাওয়ারহিটিংই যে তাঁর বেশি পছন্দ, ‘আমি পাওয়ারহিটিং পছন্দ করি। ছোটবেলা থেকে আমি এভাবেই খেলে এসেছি। হিটিংটাই আমাকে বেশি টানে।’
পাওয়ারহিটিং মানেই যে এলোপাতাড়ি ব্যাটিং নয়, ক্রিকেটীয় শট খেলেও যে ভালো স্ট্রাইক রেটে খেলা সম্ভব, কাল সেটিও পারভেজ দেখিয়েছেন ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংসে।
চট্টগ্রামের ছেলে পারভেজ। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের কারণে এলাকায় মানুষজন সে জন্যই তার সঙ্গে ‘তামিম’ নামটা জুড়ে দিতেন।
কাপড় ব্যবসায়ী বাবার ছেলে পারভেজের ক্রিকেটে আসার পেছনে পরিবারের ভূমিকা অনেক। বড় ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে এলাকায় ক্রিকেট খেলতেন পারভেজ।
ভাইয়ের বন্ধুর পরামর্শেই ভর্তি হন চট্টগ্রামের ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখান থেকে ২০১৩ সালে দিনাজপুর বিকেএসপিতে। সাভারের বিকেএসপিতে আসা ২০১৬ সালে।
ক্রিকেটার হওয়ার রাস্তায় চলতে গিয়ে হোঁচটও খেয়েছেন পারভেজ। বিসিবির বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন নিয়মিত। আশা ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলে ফেলবেন সহজেই।
কিন্তু ফর্মের কারণে ২০১৮ সালে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের দলে সুযোগ পাননি। যেতে পারেননি এর পরের শ্রীলঙ্কা সফরেও। বাদ পড়ায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন পারভেজ। খেলা, অনুশীলন—কিছুতেই মন বসছিল না তখন।
কঠিন সেই সময়ে পারভেজ পাশে পান বিকেএসপির কোচ আসাদুল হককে। তিনি পারভেজকে একরকম ধরেবেঁধে অনুশীলন করানো শুরু করেন।
অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে খেলান। সেখানে ভালো করে আবারো সুযোগ পান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। প্রথম আলোকে কোচ আসাদুল বলছিলেন, ‘পারভেজের তখন মন খুব খারাপ ছিল। ছোট মানুষ তো! অনুশীলনে খুব একটা মনোযোগী হতো না। বকাবকি করে ওর জন্য আলাদা অনুশীলনের ব্যবস্থা করলাম। বারবার ডেকে এনে অনুশীলন করাতে হতো। সে যেন মন খারাপ করার সুযোগ না পায়, সে জন্য শুক্রবারও অনুশীলন রাখতাম। একটা টুর্নামেন্টে ৯৬ রান করল। এরপর থেকেই আর পেছনে আসতে হয়নি।’
পারভেজকে অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায় থেকে দেখছেন জুনিয়র নির্বাচক হাসিবুল হোসেন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে ফরচুন বরিশাল দলের ম্যানেজার তিনি। পারভেজের উন্নতির প্রতিটি ধাপই হাসিবুলের দেখা।
এখন তো পারভেজের সামর্থ্যের পরিধি দেখে তিনি নিজেই মুগ্ধ, ‘অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে ওকে দেখে আসছি। এটাই ওর সহজাত খেলা, সব সময়ই এভাবে শট খেলতে পছন্দ করে। এই টুর্নামেন্টে সে আরও ভালো ক্রিকেট খেলেছে। ছক্কাগুলো যে মেরেছে, সবগুলোই ভালোভাবে ব্যাটে-বলে করতে পেরেছে। সোজা শট খুব ভালো খেলেছে, আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে এখানেও।’
বড়দের ক্রিকেটে পারভেজের যাত্রাটা সবেমাত্র শুরু। সামনে লম্বা পথ পড়ে আছে। সাময়িক সাফল্যে যেন গা না ভাসান এই তরুণ ক্রিকেটার, সেই বার্তা কাল ম্যাচ শেষেই দিয়েছেন হাসিবুল।
পারভেজও বলছিলেন, ‘যেটা হয়েছে সেটা কালই শেষ। এটাতে আটকে থাকলে হবে না। কাল আবার ম্যাচ আছে। এখন সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’