সতীর্থের ব্যাটে লেগে ক্যাচ, কাঁধে লেগে ক্যাচ, পায়ে লেগে ক্যাচ—অদ্ভুত যত আউট
জ্যাক লিচের ডেলিভারিকে হাফ ভলি বানাতে হেনরি নিকোলস ক্রিজ ছেড়ে এক ধাপ এগিয়ে এসেছিলেন। বলটা মাঝ ব্যাটেও পেলেন। তখন দর্শকদের চোখ অনুমিতভাবেই স্ট্রেট অঞ্চলের দিকে চলে গিয়েছিল।
টেস্টে স্পিনারকে এগিয়ে এসে ব্যাটসম্যান প্রায় সরলরেখার মতো সজোরে স্ট্রেট ড্রাইভ খেলবেন উইকেটের মাঝ দিয়ে, আর সেই শট বল নিচে থাক বা ওপরে—প্রতি এক শ বারে এক শ বারই সবাই ভেবে নেবে, বলটা স্ট্রেট দিয়ে বের হয়ে যাবে। সেখানে তো ফিল্ডার রাখা হয় না।
কিন্তু এমন ভাবনা সব সময় মেলে না বলেই বোধ হয় ক্রিকেট খেলাটা এত মজার! নিকোলস অবশ্য দার্শনিকসুলভ চাহনিতে বলতে পারেন, কিসের মজা? মাঝেমধ্যে সবার জন্য যেটা মজার কিংবা অদ্ভুতুড়ে, ভাগ্যের ফেরে তা কারও জন্য দুঃখজনকও।
অবশ্যই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাল থেকেই সবাই পাশে দাঁড়াচ্ছেন নিকোলসের। বেচারা! খেললেন স্ট্রেট ড্রাইভ, অথচ আউট হলেন কিনা মিড অফে একদম কোনায় দাঁড়ানো ফিল্ডার অ্যালেক্স লিসের হাতে! হেডিংলি টেস্টে কাল প্রথম দিনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের এই বাঁহাতির আউট না দেখে থাকলে বলতে হবে, অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যই মিস হয়ে গেছে! হ্যালির ধূমকেতু যেমন ৭৫ বছর পর দেখা যায়, তেমনি নিকোলসের আউটের ধরনও ক্রিকেট ইতিহাসে ততটাই বিরল। অদ্ভুতও। অবশ্য শুধু অদ্ভুত বললেও খানিকটা অবিচার করা হয়।
নিকোলস অবসর নেওয়ার পর নিশ্চয়ই নাতিপুতির কাছে এ আউটের গল্প বলবেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁর চোখ দুটি নস্টালজিক হয়ে চিক চিক করে উঠবে। সে সময় এ আউটকে কি আর শুধু ‘অদ্ভুত’ বন্ধনিতে আটকে রাখা সম্ভব? ব্যতিক্রম বলেই হয়তো আউটটি আলাদা জায়গা করে নেবে নিকোলসের হৃদয়ে। তখন ‘বুড়ো’ নিকোলসের অন্তত খারাপ লাগার কথা নয়। কিন্তু তাঁর পাশে ড্যারিল মিচেল থাকলে বেচারার খারাপ লাগবেই। মিচেলের জন্যই তো নিকোলস আউট!
নিকোলস শটটি খেলার পর নন–স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা মিচেল বলের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। ব্যাটটা সরাতে পারেননি। বলটা মিচেলের ব্যাটের মাঝে লেগে গতিপথ পাল্টে ধরা দেয় লিসের হাতে। এ ঘটনা যাঁরা দেখেছেন বার কয়েক চোখ কচলেও হয়তো বিশ্বাস করতে পারেননি। এটা কি আউট? বৈধ? এমন প্রশ্ন যাঁদের, তাঁদের মনের ধোঁয়াশা কাটাতে নিয়মটি জানিয়ে রাখা ভালো, ক্রিকেট আইনের ৩৩.২.২.৩ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে, ‘উইকেট, আম্পায়ার, অন্য ফিল্ডার, রানার কিংবা অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানের গায়ে বল লাগার পর ফিল্ডার ক্যাচ ধরলে তা আউট।’
ঠিক আছে, আইনে যেহেতু আছে, তাহলে আউট। কিন্তু এমন আউট শেষ কবে দেখা গেছে? নিকোলসের মতোই ঠিক ঠিক এমন আউট খুঁজে বের করতে হয়তো গবেষকের প্রয়োজন হবে। ক্রিকেটের গোটা ইতিহাস বাদ দিন, শুধু টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসই তো ১৪৪ বছরের! তবে নিকোলসের আউটের কাছাকাছি আউট দেখা গেছে। ইউটিউব কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এতক্ষণে হয়তো তা দেখেও ফেলেছেন অনেকে।
২০০৬ সালে মেলবোর্নের ডকল্যান্ডস স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে ব্যাট করছিলেন প্রয়াত অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও মাইকেল ক্লার্ক। ৩৯.১ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ যখন ৪ উইকেটে ২৩৮, তখন জন্ম হয় অবিশ্বাস্য দৃশ্যটির। জিহান মুবারকের অফ স্পিন সাইমন্ডসও স্ট্রেটে জোরে খেলেছিলেন। বল নন–স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ক্লার্কের ডান পায়ের প্যাডে লেগে জমা পড়ে মিড অনে দাঁড়ানো তিলকারত্নে দিলশানের হাতে। ধারাভাষ্যকক্ষে মার্ক নিকোলাসের কণ্ঠে বিস্ময়, ‘ইটস আ ফ্রিক ইন্ড ফর অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস!’ ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় হাসছিলেন সাইমন্ডস। তাঁর নিজেরও কী বিশ্বাস হচ্ছিল! ক্লার্কের প্রতি হাতের ইশারায় সাইমন্ডস যেন বুঝিয়ে দেন, এভাবে আউট করার জন্য আমাকে কিন্তু পান করাতে হবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টাইমস আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করে নিকোলসের আউটের কাছাকাছি আরও কিছু আউটের তথ্য জানিয়েছে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে প্রায় একইভাবে আউট হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক পেসার কবির আলী। তাঁর শট নন–স্ট্রাইকে দাঁড়ানো পল কলিংউডের কাঁধে লেগে ক্যাচ হয়। ১৯৮৪ সমারসেট-সারে ম্যাচেও প্রায় এমন আউট দেখা গেছে। ইংল্যান্ডের হয়ে ২৫ টেস্ট খেলা সাবেক অফ স্পিনার প্যাট পোকোক ছিলেন সারের ১১তম ব্যাটসম্যান। তাঁর শট অন্য প্রান্তের সতীর্থ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক পেসার সিলভেস্টার ক্লার্কের কনুইয়ে লেগে ফিরতি ক্যাচ নেন বোলার স্টিভেন বুথ।
তবে ফিল্ডারের গায়ে লেগে ক্যাচ—এমন স্মৃতি হাতড়াতে গেলে ব্রায়ান ক্লোজকে অনেকের মনে পড়তে পারে। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট খেলা প্রয়াত এই ক্রিকেটার শর্ট লেগে ভয়ডরহীন চিত্তে ফিল্ডিং করেছেন। তখন শর্ট লেগ কিংবা সিলি পয়েন্টে বলের আঘাত থেকে বাঁচতে কোনো রকম প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াই ফিল্ডিংয়ে দাঁড়াতে হতো।
১৯৬২ সালে ব্রিস্টলে চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে গ্লুচেস্টারশায়ারের ব্যাটসম্যান মার্টিন ইয়ংয়ের ক্রিজে থাকতে ক্লোজ-ইন ফিল্ডিংয়ে ছিলেন ক্লোজ। ইয়ংয়ের জোরালো শট ক্লোজের কপালে লেগে জমা পড়ে স্লিপে দাঁড়ানো ফিল শার্পের হাতে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক উইকেট-কিপার ব্যাটসম্যান ডেনিস লিন্ডসের কথাই ধরুন। ষাটের দশকের এই ক্রিকেটার কেপ টাউনে অস্ট্রেলিয়ার পেসার ডেভিড রেনেবার্গকে হুক করতে গিয়েছিলেন। তখন তো আর হেলমেটের প্রচলন ছিল না। বল তাঁর ব্যাট হয়ে মাথায় আঘাত হেনে ফিরে আসে রেনেবার্গের হাতে। বেচারা!
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৭ টেস্ট খেলা ওয়েন ফিলিপসও অদ্ভুত আউটের শিকার হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে এজবাস্টন টেস্টে ফিলিপস ৫৯ রানে ব্যাট করছিলেন। বাঁহাতি স্পিনার ফিল এডমন্ডসের বলে কাট করেন, বল সিলি পয়েন্টে দাঁড়ানো অ্যালান ল্যাম্বের পায়ের পাতায় লেগে উঠে যায়। সিলি মিড অফে দাঁড়ানো ডেভিড গাওয়ার আরাম করে ক্যাচটি নেন। তখন তো আর ডিআরএস ছিল না। ইংল্যান্ড আউটের আবেদন করার পর আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড ও ডেভিড কনস্ট্যান্ট মিলে ফিলিপসকে আউট ঘোষণা করেন।
সেই ঘটনার ৬ বছর পর ১৯৯১ সালে জর্জটাউনে আরও অদ্ভুত ও বিতর্কিত আউটের জন্ম দেন অস্ট্রেলিয়ার প্রয়াত ক্রিকেটার ডিন জোন্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার কোর্টনি ওয়ালশের বলে বোল্ড হন জোন্স। দর্শকদের হইহুল্লোড়ে জোন্স শুনতে পাননি, আম্পায়ার বলটি ‘নো’ ডেকেছেন। অর্থাৎ নো বল। জোন্স আউট ভেবে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন, অর্থাৎ ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান। উপস্থিত বুদ্ধি খাটান ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার কার্ল হুপার। নো বলে বোল্ড আউট নেই, কিন্তু রানআউট তো আছে! হুপার বল হাতে দৌড়ে গিয়ে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। এই আউট নিয়ে বিতর্কের জায়গাটা হলো, ক্রিকেটের ৩৮.২ ধারায় বলা আছে, ‘নো বল ডাকা হলে, ব্যাটসম্যান রান নেওয়ার চেষ্টা না করলে সে রানআউট হবে না।’ বলা বাহুল্য, বোল্ড হওয়ার পর জোন্স রান নেওয়ার চেষ্টা করেননি, ড্রেসিংরুমে ফিরে যাচ্ছিলেন।
অদ্ভুত আউটের সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকারের নামও জড়িয়ে আছে। ১৯৯৯ অ্যাডিলেড টেস্ট। সেটি অনেকের মতেই, ক্রিকেট ইতিহাসে শূন্য রানে আউট হওয়ার অন্যতম কুখ্যাত নজির। গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে ‘ডাক’ করেছিলেন টেন্ডুলকার, অর্থাৎ হাঁটু গেড়ে বসে বলটি ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বল তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ে আঘাত হানে। আম্পায়ার ড্যারিল হার্পার সবাইকে অবাক করে দিয়ে এলবিডব্লিউ আউট দেন! অস্ট্রেলিয়ানরা আউটটি বৈধ দাবি করলেও ভারতে কুশপুত্তলিকা দাহ হয়েছিল।
কিউই ক্রিকেটের সমর্থকদের এমন কিছু করার কোনো কারণ নেই। নিকোলসের আউটটি স্রেফ দুর্ভাগ্য। আবার এ আউটই দর্শকদের কাছে বিরল এক দৃশ্য। তাঁর উইকেটটি নেওয়া ইংলিশ স্পিনার জ্যাক লিচ বলতে দ্বিধা করেননি, ‘অবিশ্বাস্য। কখনো এমন কিছু দেখিনি। এটা যে বৈধ (আউট) সেটাই জানতাম না! নিকোলসের দুর্ভাগ্য আমার জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছে।’
একটি ডেলিভারিতে দুজন ক্রিকেটার যখন দুই রকম স্বাদ পেলেন, সেটিও বিরল এক ঘটনা—যা হওয়ার কথা ছিল (চার কিংবা এক-দুই রান, অন্তত আউট নয়) তা তো হয়ইনি, উল্টো সবার ভাবনাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে ক্রিকেট। খেলাটা এ জন্যই বোধ হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার।
তবে নিকোলস অন্তত এতে গৌরবের কিছু খুঁজে পাবেন না। লিচ পেতে পারেন, অবসর নেওয়ার পর নাতিপুতিদের কাছে এ ঘটনা বলতে গিয়ে তাঁর মনে হতেই পারে—তাঁর এ উইকেট ক্রিকেটের কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার’।