লারার চার শর মাঠ এখন যেন ধানখেত
এল্টন রবার্ট প্রতিবাদ করে উঠলেন। রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে ক্রিকেট নয়, তিনি সেন্ট জনসের শান্তি রক্ষার পক্ষে।
অ্যান্টিগার রাজধানী এলাকা বলে পরিচিত সেন্ট জনসে একটি ফাস্ট ফুডের দোকান চালান এল্টন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অ্যান্টিগার ক্রিকেটটা সেন্ট জনস রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড থেকে শহরের অনেকটা বাইরে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে চলে যাওয়ায় তাঁদের মন খারাপ হয়নি?
এল্টন রবার্ট যেন এ রকম প্রশ্ন আশাই করেননি, ‘মন খারাপ কেন হবে? ক্রিকেট এখান থেকে চলে গেছে, ভালো হয়েছে।’ এবার আরও অবাক হওয়ার পালা। কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, কেন? এল্টন কিছুটা উত্তেজিত, ‘আপনি জানেন, ক্রিকেট খেলা হলে এখানে কী হতো? পুরো শহরে যানজট লেগে যেত। এই ছোট্ট শহরে মানুষ আর মানুষ। ইংল্যান্ডের খেলা হলে তো ৫-৬ হাজার বার্মি আর্মিই আসত। শহরের শান্তি নষ্ট হতো। ক্রিকেট দূরে যাওয়ায় শহরের মানুষ আরামে আছে। যারা খেলা দেখতে চায়, তারা ওখানে গিয়ে দেখে।’
কথাটা মানতে কষ্ট হলো। ঐতিহ্য বলেও তো একটা ব্যাপার তো আছে! অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার চেয়ে এই পঞ্চাশোর্ধেরই বেশি ভালো জানার কথা। টেস্টে এ মাঠেই ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রান, এ মাঠেই অপরাজিত ৪০০, এরও আগে ভিভ রিচার্ডসের ৫৬ বলে টেস্ট সেঞ্চুরি। সবগুলোই সে সময়ের বিশ্ব রেকর্ড, লারার ৪০০ তো বিশ্ব রেকর্ড হয়ে আছে এখনো। অ্যান্টিগার যত কিংবদন্তি—অ্যান্ডি রবার্টস, ভিভিয়ান রিচার্ডস, রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোস...এঁদের বড় হওয়াও এ মাঠে খেলেই। এমন মাঠের স্মৃতি এত অবহেলায় মুছে যাবে?
মাঠটাতে ২০০৯ সালের পর আর ক্রিকেট খেলা হয় না। মাঠের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে মাঠ না বলে এটিকে ধানখেত বলাই ভালো। রবার্টস–রিচার্ডস–রিচার্ডসন–অ্যামব্রোসদের ‘ঘর’ এবং ব্রায়ান লারার কীর্তির মাঠ থেকে ক্রিকেট আজ নির্বাসিত। অ্যান্ডি রবার্টস স্ট্যান্ড, রিচি রিচার্ডসন স্ট্যান্ড আর কালো রঙের ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ড বোবার মতো দাঁড়িয়ে। অথচ অ্যান্টিগাবাসীর এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই!
রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড থেকে ক্রিকেট সরে যায় ২০০৯ সালের পর। এটা ঠিক যে অ্যান্টিগার প্রাণকেন্দ্র সেন্ট জনস অতটা প্রশস্ত এলাকা নয়। স্থানীয়দের কাছে এটা ‘টাউন’ হলেও রাস্তাঘাট খুবই সরু। বাড়িঘর, দোকানপাট প্রায় রাস্তার ওপর চলে এসেছে। উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলে এ পাশের গাড়িকে হয় থেমে, নয়তো একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে হয়।
পার্কিংয়ের জন্য আলাদা জায়গা না থাকায় মানুষ নাকি রাস্তার ওপর গাড়ি রেখেই খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ঢুকে যেত।। এ রকম জায়গায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, সেটি সহজেই অনুমেয়। লারার রেকর্ডের মঞ্চ তাই যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেন্ট জনসবাসীর জন্য।
সে তুলনায় শহরের একটু বাইরে নির্মিত স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়াম ও এর আশপাশে জায়গার অভাব নেই। আধুনিক সব সুযোগ–সুবিধাই আছে এখানে।
ক্রিকেট নির্বাসিত হওয়ার পর রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের যত্নআত্তি কমে যায়। এটি এখন ফুটবল আর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাঠ। আগামী মাসেই যেমন এখানে হবে বড় এক কার্নিভাল। সে জন্য প্রস্তুতি চলছে এখন। প্রস্তুতি বলতে স্টেডিয়াম রং করা। তবে সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞেরও প্রস্তুতি দেখে এসেছি সেদিন। মাঠ সংস্কার করতে আসা একজন রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের বিখ্যাত কাঠের ডাবলডেকার গ্যালারিটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটা ভেঙে আমরা এখানে নতুন গ্যালারি করব।’
মাঠের ক্ষতবিক্ষত চেহারাও সাক্ষ্য দেয়, এ মাঠ এখন আর ক্রিকেটের নয়। সবুজের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে আরও আগেই। মাঠটাকে মাঠ না বলে ধানখেত বলাই ভালো। এখানে–ওখানে গাড়ির চাকার দাগ দেখে মনে হচ্ছিল স্টেডিয়ামে কি তবে ড্রাইভিংও শেখানো হয় নাকি! স্থানীয় একজন অবশ্য জানালেন, সে রকম কিছু নয়। অনেকে এ এলাকায় এলে মাঠেই গাড়ি পার্ক করেন। সে জন্যই অমন টায়ারের দাগ।
রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের এমন বহুমুখী ব্যবহারে এর আসল পরিচয়টাই হারিয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো এ মাঠকে ‘লারার ৪০০ রানের মাঠ’ বলে কেউ চিনবেই না। ইতিহাসের একটা অধ্যায় বুঝি তাদের জীবন থেকে হারিয়েই যাবে। অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড কি এসব ভেবে নীরবে কাঁদে? কাঁদলেও সেই কান্না শোনার কেউ নেই।