সৌরভের কল্যাণে দুই-একটা বাংলা শব্দ শিখেছেন। তাই বলে বাংলায় একটা আস্ত বই পড়ে ফেলতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। আমার বই পড়ার জন্য অনুবাদক ভাড়া করেছেন বা করবেন বলেও মনে হয় না। এমন কিছু হয়েছে শুনলে আমি নিজেই অজ্ঞান হয়ে যাব। যতটা না আনন্দে, তার চেয়ে বেশি বিস্ময়ে। আমরা তাই ধরে নিতে পারি, আমার লেখা 'শচীন রূপকথা' বইটি শচীন টেন্ডুলকার পড়েননি।
তবে না পড়লেও বইটা যে শচীন টেন্ডুলকারের কাছে আছে, এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি। কীভাবে? আমি নিজেই যে সেটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছি। শচীন নিজে না বললে অবশ্য তা প্রমাণ করতে পারব না। দুটি বই শচীনকে উপহার দিয়েছি, আর দুটিতে অটোগ্রাফ নিয়ে সযত্নে রেখে দিয়েছি আমার কাছে। তাতে অবশ্য বইটি যে শচীন টেন্ডুলকার দেখেছেন, বড় জোর এটি প্রমাণ হয়। বইটা তাঁর কাছে আছে, এর প্রমাণ কী? না, আসলেই কোনো প্রমাণ নেই। আমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করতে অনুরোধই করতে পারি। শচীনের মুম্বাইয়ে বান্দ্রায় পেরি ক্রস রোডের ফ্ল্যাটে বইটি দেখে এসে আমার এক বন্ধু সাংবাদিক আমাকে তা জানিয়েছেন। এখন বিশ্বাস করা না-করা আপনার ব্যাপার।
শচীন রূপকথা হাতে শচীন টেন্ডুলকারের একটা ছবি তুলে রাখলে প্রমাণটা আরও অকাট্য হতো। বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছেন, কাভার-ব্যাক কাভার দেখার পর পৃষ্ঠাসংখ্যাও। ভিনদেশি এক সাংবাদিক তাঁকে নিয়ে ২১৪ পৃষ্ঠার একটা বই লিখে ফেলেছেন জেনে চোখেমুখে একটু যেন খুশির আভাও। সংগ্রহে রাখার মতো একটা ছবিই হতো। কিন্তু ছবি তোলার কথা যে আমার মনেই আসেনি। যা নিয়ে এখনো আমার একটু আফসোস হয়। এই 'বদভ্যাস' নিয়েই। এত সব কিংবদন্তির সঙ্গে কথা বলেছি, সাক্ষাৎকার নিয়েছি, বলতে গেলে কারও সঙ্গেই ছবি তোলা হয়নি।
শুরুর দিকে 'মহৎ' একটা কারণ ছিল। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার অনেক আগে থেকেই বড় বড় ইন্টারভিউ করেছি। শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম ইন্টারভিউও এর চার বছর আগে। বাংলাদেশের সাংবাদিক হিসাবে অকারণ একটা বাড়তি দায় অনুভব করতাম তখন। নিজেকে এবং বৃহত্তর অর্থে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পেশাদার প্রমাণ করার দায়। মনে হতো, ইন্টারভিউ শেষ করে ছবি তুলতে চাইলেই পেশাদার সাংবাদিক থেকে ভক্তে রূপান্তরিত হয়ে যাব! যে কারণে তারকাদের সঙ্গে আমার ছবি নেই বললেই চলে। শচীনের সঙ্গেও নেই। নইলে বিস্ময়-বালকের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে একটা ছবি পোস্ট করে শচীনকে শুভেচ্ছা জানানো যেত।
বিস্ময়-বালক! শচীন টেন্ডুলকারের আজ ৫০ হলো, আর তাঁকে কি না বলছি বিস্ময়-বালক! শচীনকে নিয়ে আমার এটা পুরনো সমস্যা। বেবি ফ্যাট মুখে নিয়ে ১৬ বছর ২০৫ দিন বয়সে টেস্ট অভিষিক্ত বালকের বয়স কীভাবে যেন সেখানেই থমকে আছে। এর একটা কারণ হতে পারে, টেস্ট অভিষেকের বছর তিনেক আগে থেকেই শচীন টেন্ডুলকার প্রসঙ্গে বিস্ময়-বালক কথাটা শুনতে শুনতে সেটিই মনে গেঁথে গেছে। দাড়ি-গোঁফেও চেহারাছবিতে ভারিক্কি ভাব না আসাও হয়তো আরেকটা কারণ। টেস্ট অভিষেকের পরের বছর প্রথম যখন তাঁকে দেখি, বয়স মনে হয়েছিল আরও কম। সেই প্রথম দেখা ১৯৯০ সালে ঢাকায় আজহার একাদশ ও ইমরান একাদশের মোড়কে ভারত-পাকিস্তান দুটি প্রদর্শনী ম্যাচের কল্যাণে। শেরাটন হোটেলের দোতলায় কপিল দেব-রবি শাস্ত্রী-দিলীপ ভেংসরকারদের আড্ডার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। শচীন সেখানে নেই। একটু পর দেখি, টি শার্ট-জিন্সে ফুলবাবু সেজে তিনি আসছেন।
পাকিস্তানে ইমরান-আকরাম-ওয়াকারের আগুনে বোলিংয়ের বিপক্ষে অভিষেকের পর নিউজিল্যান্ড সফরও করে ফেলেছেন ততদিনে। নেপিয়ারে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটা হাত ফসকে গেছে মাত্র ১২ রানের জন্য। সবকিছু জানা থাকার পরও শচীনকে প্রথম দেখার বিস্ময়টা এখনো মনে করতে পারি। মুখে বেবি ফ্যাট তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তখনো, ঘাড়ে রেশমের মতো রোয়া রোয়া চুল। এই পিচ্চিই আরও এক বছর আগে ওয়াকার ইউনুসের বাউন্সারে রক্তাপ্লুত নাক মুছে পরের বলটিই পাঠিয়েছে বাউন্ডারিতে! মিনিট পাঁচেকের কথাবার্তায় এই প্রসঙ্গটাও এসেছিল। ছেলেমানুষী একটা প্রশ্নও করেছিলাম, 'ইমরান-আকরাম-ওয়াকারকে খেলতে ভয় লাগেনি?' উত্তরটাও ছিল বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, 'শুরুতে একটু লেগেছিল। একটা বাউন্ডারি মারার পর আর লাগেনি।'
এরপর আরও কত স্মৃতি! আমার অনুল্লেখ্য সাংবাদিক জীবন আর শচীনের রূপকথার মতো ক্যারিয়ার একই সমান্তরালে এগিয়েছে। শচীনকে নিয়ে আড্ডায় যেটিতে একটু মশলা মিশিয়ে আমি বলি, আমার আর শচীনের মধ্যে বড় একটা মিল আছে। আমাদের দুজনের ক্যারিয়ার একই বছরে শুরু। শচীনকে নিয়ে এত হইচই আর আমাকে নিয়ে কিছুই না—এ নিয়ে কৃত্রিম আক্ষেপও প্রকাশ করেছিলাম একটি লেখায়। একটি ভারতীয় ওয়েবসাইটে ইংরেজিতে লেখা বলে শচীনের সেটি চোখে পড়তে পারে বলেও অনুমান করি। তা পড়ুক না পড়ুক, ওই ওয়েবসাইটের সম্পাদক কথাটাতে খুব মজা পেয়েছিলেন।
শচীন যদি রেকর্ডের বরপুত্র হন, শচীন সম্পর্কিত আমারও একটা রেকর্ড আছে বলেও দাবি জানিয়েছিলাম ওই লেখাটিতে। এটি অবশ্য রসিকতা ছিল না। কী সেই 'রেকর্ড'? প্রেসবক্সে বসে শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর শততম সেঞ্চুরি দেখা একমাত্র সাংবাদিক আমি। এটিকে রেকর্ড বলবেন কি না, সেটি অবশ্য আপনার ব্যাপার।
শচীনের ওয়ানডে সেঞ্চুরি না পাওয়া নিয়ে কোটি কোটি শব্দ লেখা হয়ে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সেটি এসেছিল ৭৯তম ম্যাচে, ৭৬তম ইনিংসে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরির সময় আমি কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে। এর ১৮ বছর পর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের শততম সেঞ্চুরি। যেটি নিয়ে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি বই কম কথা হয়নি। এশিয়া কাপের সেই ম্যাচে শচীনের ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরির পরও বাংলাদেশের জয়ের গল্পটা আমি লিখিনি।
না লেখার পেছনের গল্পটা বলি। আমার বড় ছেলে স্বপ্ন খুব খেলাপাগল। অথচ মাঠে বসে শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখেনি কখনো। এই সুযোগ আর আসবে না বুঝতে পেরে সেদিন মাঠে নিয়ে গেছি ওকে। সহকর্মীদের বলে দিয়েছি, আজ ম্যাচ রিপোর্ট তো করবই না, কিছু লিখবও না। ল্যাপটপও নিইনি সঙ্গে। তারপরও ঠিকই লিখলাম। লেখাটার শিরোনাম থেকেই বিষয়টা অনুমান করে নিতে পারবেন— 'এটাও কি একটা রেকর্ড নয়!' লেখার সিদ্ধান্তটা হুট করেই। স্বপ্নকে নিয়ে প্রেসবক্সের পাশের একটা রুম বসে খেলা দেখছি আর প্রেসবক্সে যাওয়া-আসা করছি। শচীনের সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর আবারও চক্কর দিলাম প্রেসবক্সে। সেখানে গিয়েই মনে হলো, আরে, শচীনের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির সময় প্রেসবক্সে যে সাত/আটজন সাংবাদিক ছিলেন, আমি ছাড়া আর কেউই তো এখানে নেই। আত্মপ্রচারের সংকোচ ঝেড়ে ফেলে কার কাছ যেন ল্যাপটপ ধার করে সেটি সবিস্তারে সবাইকে জানিয়েও দিলাম।
আত্মপ্রচার যখন হচ্ছেই, আরেকটু করি। এসব খুচরো ব্যাপার-স্যাপারকে 'রেকর্ড' ধরলে তেমন রেকর্ড আমার আরেকটি আছে। শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট ম্যাচ কাভার করা বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক আমি। সেই ম্যাচে অ্যাক্রিডিটেশন পেতে জান বেরিয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রেসবক্সে জায়গা দিতেই আয়োজকেরা হিমশিম খাচ্ছেন, বিদেশি সাংবাদিকদের তাই পত্রপাঠ 'না'। একে-তাকে ধরে শেষ পর্যন্ত শচীনের বিদায়বেলায় ওয়াংখেড়ের প্রেসবক্সে থাকতে পারাটাকে আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের একটি বলে মানি। এই আবেগময় অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না। টেস্ট ম্যাচ শেষে আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনার সময় গ্যালারি থেকে 'সাচিন-সাচিন' বলে গগনভেদী কোরাস, শচীনের ওই অবিশ্বাস্য বক্তৃতা, শচীন ভক্ত সুধীর গৌতমের নেচে নেচে শঙ্খ বাজিয়ে যাওয়া, ভারতের টিম বাস মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার দুই-তিন ঘণ্টা পরও স্টেডিয়ামের বাইরে ভক্তদের জটলা....সব কিছু এমন একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল যে, স্টেডিয়াম থেকে হাঁটা দূরত্বের হোটেলে ফেরার পরও দেখি, সবকিছু কেমন যেন আধিদৈবিক বলে মনে হচ্ছে!
ওয়াংখেড়ের মূল ফটকের বাইরে হাতে বিশাল একটা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে দশ-পনের জনের একটা দল। বহুবর্ণ সেই ব্যানারের নিচে লেখা, 'ক্রিকেট উইল নট বি দ্যা সেম অ্যানি মোর'। ওপরে ক্রিকেট ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে—বিএস: বিফোর শচীন, এএস: আফটার শচীন।
স্টেডিয়ামের বাইরে যে জটলার কথা বলছিলাম, তার একটির কথা আলাদাভাবে মনে আছে। ওয়াংখেড়ের মূল ফটকের বাইরে হাতে বিশাল একটা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে দশ-পনের জনের একটা দল। বহুবর্ণ সেই ব্যানারের নিচে লেখা, 'ক্রিকেট উইল নট বি দ্যা সেম অ্যানি মোর'। ওপরে ক্রিকেট ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে—বিএস: বিফোর শচীন, এএস: আফটার শচীন। পাশেই একটা দাঁড়িপাল্লার ছবি। যেটির এক দিকে হাস্যমুখ শচীন টেন্ডুলকার, অন্যদিকে ভারতীয় দলের বাকি সবাই। টেন্ডুলকারের পাল্লাটা প্রায় মাটি ছুঁয়ে অন্য পাল্লাটাকে তুলে দিয়েছে আকাশে। ভারতীয় জনমনে শচীনের অধিষ্ঠানের আদর্শ প্রতীকি উপস্থাপনা মনে হয়েছিল ছবিটাকে। রিপোর্টটা লিখতে কেমন কষ্ট হয়েছিল, সেটিও মনে আছে। 'মুম্বাই থেকে উৎপল শুভ্র' লেখার পর এক ঘণ্টারও বেশি সময় কি-বোর্ডে নিশ্চল হয়ে আছে আঙুল। বুঝতে পারছি না, লেখায় কীভাবে ফুটিয়ে তুলব আবেগবন্যার এই অভূতপূর্ব প্রদর্শনী!
শচীনকে নিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেলার সিদ্ধান্তটা তখনই নেওয়া। তা সিদ্ধান্ত তো নিলাম, কিন্তু লিখবটা কী? দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে শচীন টেন্ডুরকারকে নিয়ে যত লেখা হয়েছে, ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো ক্রিকেটারকে নিয়েই তা হয়নি। নতুন আর কী লেখার আছে! বই লেখার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। কিন্তু নয়-দশ দিন চলে গেছে, শুরুই করতে পারিনি। রীতিমতো উদভ্রান্ত লাগছে নিজেকে। শেষ পর্যন্ত বই একটা হলো, ভালো না মন্দ সেই বিচার পাঠকের হাতে ন্যস্ত। শুধু এটুকু বলি, বইয়ের প্রস্তুতিপর্বে শচীনের ক্যারিয়ার, রেকর্ড এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন অবিশ্বাস্য কিছু জিনিস আবিস্কার করেছি যে, নিজেই রীতিমতো চমকে গেছি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুকারের অভিষেক ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর। কী বিস্ময়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষবারের মতো তাঁকে ব্যাটিং করতে দেখল ২৪ বছর পর আরেক ১৫ নভেম্বরেই। শুরুটা যেমন তাঁর হাতে ছিল না, শেষটাও তো নয়। কত ভ্যারিয়েবলস্ জড়িয়ে এর সঙ্গে! হুট করে আয়োজিত তাঁর শেষ সিরিজটার শেষ টেস্টের সঙ্গে প্রথমটার মিলে যাওয়া দিয়ে যেটির শুরু। এরপরও তো আরও কত কিছু! টসজয়ী দলের সিদ্ধান্ত, ইনিংসের দৈর্ঘ্য, অন্য ব্যাটসম্যানের আউট হওয়ার ওপর নির্ভরশীল শচীনের নিজের ব্যাটিংয়ে নামার সময়, উইকেটে তাঁর নিজের স্থিতিকাল...। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে না হেরে ভারতকে আবার ব্যাটিং করাতে পারলেই তো ১৫ নভেম্বরের মহিমা শেষ হয়ে যায়।
শুরু আর শেষের এই মিল আমার আবিস্কার নয়। ভুতুড়ে মনে হওয়া এই অবিশ্বাস্য মিল নিয়ে মুম্বাই টেস্টের সময়ই সবিস্ময় আলোচনা হয়েছে। বইয়ের জন্য আমার গবেষণায় নতুন যা পেলাম, সেটি বলি। মুম্বাইয়ে শেষবারের (শেষবারটা তখন ছিল অনুমান) মতো যখন ব্যাটিং করতে নামছেন, সময়টা দেখে রেখেছিলাম। ভারতীয় সময় বিকেল তিনটা বেজে ৩৪ মিনিট। শুরু আর শেষের তারিখটা মিলে গেছে দেখে কৌতূহল, নিছকই কৌতূহলভরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটিং করতে নামার সময়টা উদ্ধার করার অভিযানে নামলাম। করাচি টেস্টের স্কোরকার্ড যা বলছে, সেটিও দিনের শেষ সেশনেই হবে। সেই টেস্ট কাভার করেছেন, এমন ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে 'তিনটা নাগাদ'-এর চেয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু পেলাম না। কৌতূহলটা তাতে আরও বেড়ে গেল। বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে বৈভব পুরান্ডারের লেখা শচীন টেন্ডুলকার জীবনীতে সময়টা পেলাম এবং বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। করাচিতে শচীন ব্যাট করতে নেমেছিলেন বিকেল ৩টা ৪ মিনিটে। পাকিস্তানে ৩টা ৪ মানে ভারতে তখন ৩টা ৩৪! যার অর্থ, শচীন টেন্ডুলকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ও শেষ ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমেছেন একদিন আগে-পরের একই সময়ে!
কাকতালীয় মিলের এখানেই শেষ নয়। শচীনের মোট আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসাব করুন। ২০০ টেস্ট, ৪৬৩ ওয়ানডে, ১টি টি-টোয়েন্টি...যোগফল ৬৬৪। এই '৬৬৪' সংখ্যাটাই তো শচীন টেন্ডুকারের আগমনী বার্তা শুনিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটকে। স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে ৬৬৪ রানের রেকর্ড জুটিটিই ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর নাম। সেটি ১৯৮৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২২ বছর পর আরেক ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই শচীনের ব্যাট থেকে ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি!
'কাকতালীয়' শব্দটাকেও আসলে অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। শচীনের টেস্ট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট সেঞ্চুরির সংখ্যাই দেখুন না! ২০০ টেস্ট আর ১০০ সেঞ্চুরি—কল্পনার ঘোড়া ছোটানো ঔপন্যাসিকও তো বড় বেশি নাটকীয় হয়ে যায় ভেবে এমন কিছু লেখার সাহস পাবেন না। শুনতে ভালো শোনায় জেনেও সংখ্যা দুটিকে একটু কম-বেশি করে দেবেন।
শচীনের শেষ টেস্টে আমন্ত্রিত এক সময় তাঁর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রায়ান লারা বলেছিলেন, 'হি হ্যাজ স্ক্রিপ্টেড দ্য গ্রেটেস্ট এভার ক্যারিয়ার।' কিন্তু এমন একটা 'স্ক্রিপ্ট' লিখল কে? সরল উত্তর তো অবশ্যই শচীন টেন্ডুলকার নিজেই। কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ারে নিয়তি নির্ধারিত এত সব ঘটনা দেখে কেন যেন মনে হয়, কোনো মনুষ্যের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। এই চিত্রনাট্য হয়তো ক্রিকেট বিধাতার নিজের হাতে লেখা।
শচীন রূপকথা!