ক্রাইস্টচার্চে কোয়ারেন্টিন পর্ব শেষ করে বাংলাদেশ দল এখন কুইন্সটাউনের অনুশীলন ক্যাম্পে। কেমন কেটেছে কোয়ারেন্টিন, সিরিজের প্রস্তুতিই–বা কেমন চলছে? নিউজিল্যান্ডে দলের সঙ্গে থাকা নির্বাচক হাবিবুল বাশার প্রথম আলোর পাঠকদের জানিয়েছেন সেসবই—
নিউজিল্যান্ড সফরে আসার আগে কোয়ারেন্টিনের সময়টা নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে শঙ্কা ছিল। সময়টা কেমন যাবে, কত নিয়মই না মানতে হয় এখানে! জৈব সুরক্ষাবলয় আর কোয়ারেন্টিন তো ভিন্ন ব্যাপার। আমাদের জন্য এটা একেবারেই নতুন।
নিউজিল্যান্ডে পা দিয়ে বুঝলাম, সময়টা আসলেই কঠিন যাবে। বিমান থেকে বোর্ডিং ব্রিজ পার হতেই এক ঘণ্টার মতো লেগে গেল। ইমিগ্রেশন বিভাগ বা বিমানবন্দরের যেখানেই গেছি, আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। শুধু আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।
করোনাবিধি বা কোয়ারেন্টিন নিয়ে যেসব বিষয় আমরা শুরু থেকে শুনে আসছি, এখানে সেসব অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হয়। হোটেলে ঢোকার সময় সবার হাতে একটা করে বুকলেট ধরিয়ে দেওয়া হলো। প্রত্যেককে আলাদা করে সব নিয়মকানুন বুঝিয়ে দেওয়া হলো। রুমে ঢোকার পর মনে হলো, আমি যেন বন্দী কারাগারে! রুম কোয়ারেন্টিন তো নয়, যেন জেল কোয়ারেন্টিন!
শুরুর দিকে শুধু সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে ৮টা পর্যন্ত রুমের জানালা খোলা রাখার অনুমতি ছিল। রুমের দরজার সামনে খাওয়া রেখে যেত হোটেলের স্টাফরা। আমার উল্টো দিকের রুমে ছিলেন আমাদের মিডিয়া ম্যানেজার রাবীদ ইমাম। তাঁকে ফোন করে বলতাম খাওয়া নিতে রুমের দরজা খুললে যেন আমাকে আগে ফোনে জানান। তাহলে আমিও তখন দরজা খুলব। দুজনের একটু দেখা-সাক্ষাৎ হবে। আমরা যখনই দরজা খুলতাম, দুজন একসঙ্গে দরজা খুলতাম।
তিন দিন পর দ্বিতীয় কোভিড পরীক্ষায় যখন সবই নেগেটিভ এল, তখন পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়ে ওঠে। প্রথমে দিনে ৩০ মিনিট হোটেলের ভেতর একটা খোলা জায়গায় ভাগে ভাগে গিয়ে হাঁটাহাঁটির অনুমতি মেলে। তবে সেখানেও পাহারা ছিল, আমরা যেন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি, সে জন্য পাহারা। রুম থেকে বের হলেও সব সময় দেখতাম বাইরে একজন বসে আছে। তারপরও আমরা সব মিলিয়ে খুশি ছিলাম। বাইরে বের হতে দিচ্ছে, এটাই তো যথেষ্ট!
তৃতীয় টেস্টেও সবাই নেগেটিভ আসার পর অনুশীলনের জন্য আমাদের মাঠে যেতে দেওয়া হলো। এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। এর মধ্যে অবশ্য অনেক দিন কেটে গেছে কোয়ারেন্টিনের। সবার রুমে সাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। টুকটাক এক্সারসাইজের সরঞ্জাম ছিল। নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া হয়েছে। এই সময়ে করোনাভাইরাসের শুরুতে দেশেই হয়ে যাওয়া একটা অভ্যাস আমার ভালো কাজে লেগেছে।
বাসায় যাঁর যাঁর থালাবাসন তো নিজেই ধুয়েছি সে সময়। এখানেও রুম কোয়ারেন্টিনে সেটাই ছিল নিয়ম। ওরা আমাদের দেওয়া প্লেট, চামচ, বাটি ফেরত নিত না। আমরা নিজেরাই সেসব ধুয়ে রাখতাম। রুম পরিষ্কার করা, ঝাড় দেওয়া এসবও নিজেরা করেছি। প্রথম তিন দিন তো রুমের তোয়ালেও বদলে দেয়নি! আসলে আমাদের কোনো কিছুই স্পর্শ করত না ওরা। বিছানা বদলেছে ছয় দিন পর।
ওরা শুরুতেই বলে দিয়েছিল, নিয়ম ভাঙলে আমাদের কোয়ারেন্টিন সময় বেড়ে যাবে। আর নিয়ম না ভাঙলে ১৪ দিন পরই মুক্ত। কোভিড-১৯ আসার আগে আমাদের যে জীবন ছিল, নিউজিল্যান্ডে বাকি সময় আমরা সে জীবনে ফিরে যেতে পারব। আমরা সে আশায়ই দিন গুনছিলাম। কোয়ারেন্টিন সময় বেড়ে গেলে কুইন্সটাউনে এখন অনুশীলনের যে সুবিধাটা পাচ্ছি, সেটা পেতাম না। দুই দিন অনুশীলন করেই ম্যাচ খেলতে হতো।
কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন পর যখন হোটেল থেকে বের হলাম, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বের হওয়ার পথে একটা ময়লার পাত্র ছিল, সেখানে আমরা সবাই মুখের মাস্ক ফেলে বের হয়েছি। অন্তত নিউজিল্যান্ডে যত দিন আছি তত দিন আর মাস্ক পরতে হবে না! এটা ভেবে যেন জেলগেট থেকে বের হওয়ার আনন্দ পেলাম।
এ রকম কঠোর কোয়ারেন্টিন সময় পার করার পর যদি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জায়গা পছন্দ করতে বলা হয়, সবাই বোধ হয় কুইন্সটাউনেই আসতে চাইবে। এখানে আমরা আছি একদম সিটি সেন্টারে, চমৎকার একটা জায়গা। পাশেই লেক, আশপাশে প্রচুর রেস্তোরাঁ। নিউজিল্যান্ডে এখন আর কেউ মাস্ক পরে না। কোভিডের কোনো নিয়মই এখানে আর নেই। সেই আগের জীবন। বিদেশ থেকে আসাদেও ওরা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে কোনো ছাড় দেয়নি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
কুইন্সটাউনে এসে পরদিন থেকেই দলবদ্ধ অনুশীলন শুরু হয়েছে। পরপর দুই দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত খুব ভালো অনুশীলন হয়েছে। অনুশীলনের জন্য এখানেও খুব ভালো সুবিধা। মাঝ উইকেট পাচ্ছি। মূল মাঠের পাশে আরেকটা মাঠে তিনটি নেট আছে। সেখানেও অনুশীলন করা যাচ্ছে।
ক্রাইস্টচাচের্র সাত দিন আমরা জিম, ফিজিক্যাল ট্রেনিং আর ফিল্ডিং অনুশীলন অনেক বেশি করেছি। কিন্তু নেট বোলার না থাকায় নেট অনুশীলন করা যায়নি। কুইন্সটাউনে স্কিলের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি। এসবের মধ্যে একটা বিরতিও দরকার ছিল। গত পরশু সেটিও পেয়েছি। সবাই মিলে ছুটির দিনটা খুবই উপভোগ করেছি।
প্রথম ওয়ানডের উদ্দেশে ১৭ মার্চ ডানেডিন যাওয়ার আগে কাল এখানে নিজেদের মধ্যে একটা প্রস্তুতি ম্যাচ হবে। দুই দলে ২২ জন খেলোয়াড় পূরণ করতে স্থানীয় খেলোয়াড়ও নেওয়া হবে ৫ জন। এরপর ২০ মার্চ প্রথম ওয়ানডে দিয়ে শুরু হবে আসল যাত্রা।
ফলাফল শেষ পর্যন্ত কেমন হবে, সেটা নির্ভর করবে আমরা মাঠে কেমন খেললাম তার ওপর। তবে নিঃসন্দেহে প্রস্তুতি ভালো হচ্ছে। ভালো খেলার জন্য যে অনুশীলন বা সময়টা দরকার ছিল সেটা আমরা এবার নিউজিল্যান্ডে এসে পেয়েছি। আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারও পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল। বলতে পারেন সম্ভাব্য সেরা ফলাফলের জন্য যা যা দরকার, সবই পাচ্ছে দল। কিন্তু সেসব তখনই সার্থক হবে, যখন মাঠের ফলাফলটা ভালো হবে।