যেদিন বাংলাদেশ দুবার হারল!
স্কোরকার্ডে লেখা থাকবে বাংলাদেশ ৫০ রানে হেরেছে। কিন্তু ক্রিকেট শুধু রান বা উইকেটের খেলা তো নয়; ক্রিকেট কখনো কখনো রান-উইকেটের ঊর্ধ্বে উঠে যায় বলেই ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। নিদাহাস ট্রফিতে যে বাংলাদেশ এক প্রাপ্য নো বলের দাবিতে মাঠে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল, আজ সেই বাংলাদেশের খাতাতেই অন্যায় নো বল লেখা হলো। আম্পায়ার তানভীর আহমেদের ভুলের দায় অবশ্যই বাংলাদেশ দলের নয়। কিন্তু এই ভুলের দায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের! ওই ন্যক্কারজনক মুহূর্তের খেসারত কি বাংলাদেশ দলকেও দিতে হয়নি? যে বাংলাদেশ উড়ন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটিতে নামিয়েছিল ব্যাট হাতে, এরপর নিজেরাই বড় লক্ষ্যে দিকে ছুটছিল মিগ টোয়েন্টি নাইনে সওয়ার হয়ে; এরপর সেই দুটি অন্যায় নো বলের অভিশাপে বাংলাদেশ পুড়ল!
সংস্কারবাদী যদি নাও হন, ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যাতেও বুঝবেন। ওই বিতর্কিত ওভার খেলার মোমেন্টাম পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। মানসিকভাবে নুয়ে পড়া ক্যারিবীয়দের ভীষণভাবে উজ্জীবিত করেছে। এরই ফলাফল, ওই ওভারের পরই ১ রানের মধ্যে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল ৩ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে। ১ উইকেটে ৬৫ তুলে ফেলা বাংলাদেশ তখন ৪ উইকেটে ৬৬। ওই ঘটনা ক্যারিবীয়দের কতটা তাতিয়ে দিয়েছে, সেটা প্রতিটা উইকেট উদ্যাপনে তাদের উচ্ছ্বাস দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। দারুণ একটা ম্যাচ দেখার অপেক্ষায় ছিল যে দর্শকেরা, বাংলাদেশের ইনিংসের ১০ ওভারের মধ্যেই তাদের অর্ধেকের বেশি ঘরে ফেরার পথ ধরল। ৯.৪ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর যে ৭ উইকেটে ৮৯ রান! শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ১৪০ রানে, ১৭ ওভারে। লিটনের ব্যাট থেকে এসেছে সর্বোচ্চ ৪৩ রান। এর বাইরে সর্বোচ্চ আবু হায়দারের ২২। মেহেদী হাসান মিরাজ করেছেন ১৯।
অথচ হয়তো ম্যাচ এবং সিরিজ দুটোই দারুণভাবে জিতে যেতে পারত বাংলাদেশ। ২ উইকেটে ১২২ রান তুলে ফেলা ক্যারিবীয়দের বাংলাদেশ প্রথম আটকে দিয়েছে ১৯০ রানে। ৭৮ রানে তুলে নিয়েছে তাদের শেষ ৮ ব্যাটসম্যানকে। বোলারদের এই উজ্জীবিত পাল্টা লড়াইয়ে সওয়ার বাংলাদেশ এরপর ব্যাট হাতেও দারুণ শুরু করে। ৪ ওভারে ১ উইকেটে ৬২ রান বাংলাদেশের।
এই চতুর্থ ওভারটাতেই যত ঘটনা। ওশান টমাসকে দুই বল আগেও ‘নো’ ডেকেছিলেন তানভীর আহমেদ, পরে টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল, টমাসের পা দাগের ভেতরেই ছিল। শেষ বলেও ঠিক একই ঘটনা, আবারও টমাসের বলটা নো ডাকেন আম্পায়ার। পরপর দুটি ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা। ৯ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নেমে আসতে হয়েছিল ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোকে।
এই সিরিজে আম্পায়ার তানভীরের কিছু হাস্যকর ভুল সিদ্ধান্ত আগেও চোখে পড়েছে। আজ দৃষ্টিকটু লাগল বোলারের পা দাগের বেশ ভেতরে থাকার পরও পরপর দুবার নো বল ডাকলেন। এর মধ্যে দ্বিতীয়বার ডাকা নো-এর সময় লিটন দাস মিড অফে ক্যাচও দিয়ে ফেলেছিলেন। ক্যারিবীয় খেলোয়াড়েরা মাঠের বড় পর্দায় দেখেন, বলটি নো ছিল না। এরপরই অধিনায়ক কার্লোস ব্রাফেটের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
অবস্থা এমনই দাঁড়ায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলোয়াড়েরা যেন মাঠ থেকে বেরিয়ে যান! ব্রাফেট আম্পায়ার তানভীরকে রিভিউ নেওয়ার কথা বলেন। আম্পায়ার জানান, নো বল হয়েছে কি হয়নি, এটা জানতে রিভিউ নেওয়ার সুযোগ নেই। ব্রাফেট আরও চটেন। চলে যান মাঠের বাইরে। কথা বলেন উইন্ডিজ টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। কথা বলেন রিজার্ভ আম্পায়ার শরফুদ্দৌলার সঙ্গে। ব্রাফেটের অভিব্যক্তি দেখে যেটা বোঝা গেল, তাঁর একটাই দাবি, আম্পায়ার বারবার ভুল ‘নো’ বল দিচ্ছেন। একটা পর্যায়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসেন ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো। ব্রাফেট, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম ম্যানেজমেন্ট, ম্যাচ রেফারি, রিজার্ভ আম্পায়ারের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। সাকিব অবশ্য বেশির ভাগ সময় নীরব দর্শক হয়েই থেকেছেন।
সাকিবকে এই ঘটনার দৃশ্যপটে দেখতে পেয়ে অনেকের মনে পড়ার কথা গত মার্চের নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা ম্যাচটির কথা। উদানার একই ওভারের দ্বিতীয় বাউন্সার নো হয় ক্রিকেটীয় আইনে। কিন্তু লেগ আম্পায়ার নো বল না ডাকায় খেপে যায় বাংলাদেশ। ড্রেসিংরুম থেকে সাকিবের ইশারায় বাংলাদেশ দল মাঠ ছাড়ে। সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটীয় চেতনার পক্ষে লড়াই করেছিল। আজ বাংলাদেশ হয়ে থাকল দর্শক। লিটন ওয়াক করে বের হয়ে আসতে পারতেন হয়তো। যদিও সে সময় দারুণ ব্যাট করতে থাকা লিটনের পক্ষে যুক্তি থাকবে, আম্পায়ারের নো শুনেই তিনি মেরে খেলতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ সর্বোচ্চ যা করতে পারত, ক্রিকেটীয় চেতনায় ওই নো বলের সুবাদে পাওয়া ফ্রি হিটটি মেরে না খেলে ডিফেন্স করলে।
বাংলাদেশ দলকে এই মুহূর্তে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ভুলই হবে। যখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওই ঘটনায় মূল শিকার শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশই হলো। ওই একটা মুহূর্ত ম্যাচ থেকে বাংলাদেশকে ছিটকে দিল। তাতে ক্যারিবীয়দের কৃতিত্ব অবশ্যই বেশি।
বাংলাদেশ দলের দায় না থাকলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির দায় অবশ্যই আছে। এই টি-টোয়েন্টি সিরিজেই অভিষিক্ত তানভীর ঘরোয়া ক্রিকেটে বাজে আম্পায়ারিংয়ের জন্য বিশেষভাবে সুখ্যাত। এর আগেও খোদ সাকিব ও তামিমের সঙ্গে মাঠেই বাদানুবাদ হয়েছিল তানভীরের। এই সিরিজেও সাকিব তানভীরের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ম্যাচ ফির ১৫ শতাংশ জরিমানা গুনেছেন।
আম্পায়ারদের জরিমানা গোনার নিয়ম নেই। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিশ্ব ক্রিকেটের কাছে হাস্যোষ্পদ করার দায় তানভীর নেবেন কি?