যত ‘এমন কিছু’র জন্ম দিল বাংলাদেশ

লজ্জাবনত মুখে মাঠ ছাড়ছে বাংলাদেশ দল।ছবি: শামসুল হক

রান, উইকেট, বল, মিনিট—ক্রিকেট মানেই পরিসংখ্যান। এ কারণেই খুব কম ম্যাচই হয় যেখানে কোনো রেকর্ড হয় না। বিশ্ব রেকর্ড, দেশের রেকর্ড, মহাদেশীয় রেকর্ড, নির্দিষ্ট উইকেট জুটির রেকর্ড, ডান হাতির রেকর্ড, বাঁহাতির রেকর্ড...মাপকাঠিও তো কম নয়! আর এসব মাপকাঠিতেও যদি আটকানো না যায়, তবে আরেকটি কথাও যোগ করা যায়। ‘এমন কিছু সর্বশেষ দেখা গেছে…!’

চট্টগ্রাম টেস্টের শেষ দিন দুপুরেই এমন এক ‘এমন কিছু’ হাজির হয়েছিল। ২৮ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটের স্বাদ পেয়েছেন কাইল মেয়ার্স। করোনায় বাংলাদেশের জৈব সুরক্ষাবলয়ের আয়োজনে স্বস্তি না পেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল খেলোয়াড়েরা যদি সরে না যেতেন, তাহলে হয়তো এ ম্যাচ খেলাও হতো না তাঁর।

সেই মেয়ার্স অভিষেকে সেঞ্চুরি তো বটেই, পরে ডাবল সেঞ্চুরিও পেয়ে গেলেন। অপরাজিত রইলেন ২১০ রানে। ব্যক্তিগত ইতিহাসের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও ইতিহাস গড়া এক জয় এনে দিয়ে মাঠ ছেড়েছেন।

বাংলাদেশের বিপক্ষে মেয়ার্স যত রেকর্ডের জন্ম দিলেন, সেটা লিখতেই হয়তো রেকর্ডের আরেকটি নতুন পাতা ভরে যাবে। বাংলাদেশের মাটি ছাপিয়ে উপমহাদেশ, এশিয়া, এমনকি বিশ্ব রেকর্ডেরও জন্ম দিয়েছেন মেয়ার্স।

মেয়ার্স অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করেছেন আজ।
ছবি: প্রথম আলো

অভিষেক ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডই টেস্ট ক্রিকেট ১৪৪ বছরে এই প্রথম দেখল মেয়ার্সের সৌজন্যে। ডাবল সেঞ্চুরি তো নয়ই, অভিষেক ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরিই বিরল ঘটনা। এর আগে মাত্র সাতবার এমন কিছু দেখেছে ক্রিকেট। সর্বশেষ ঘটনা ২০১২ সালে। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি অভিষেকে অ্যাডিলেডে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন। তবে সে কীর্তির সঙ্গে বাংলাদেশ জড়িয়ে নেই। বরং মেয়ার্স ফিরিয়ে এনেছেন ১৮ বছরের পুরোনো এক কীর্তি।

২০০৩ সালে অভিষেক হয়েছিল ইয়াসির হামিদের। করাচিতে সেবার দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭০ রানের পর চতুর্থ ইনিংসে ১০৫ রান করেছিলেন ইয়াসির। বাংলাদেশের বিপক্ষে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ ব্যাটসম্যান, যিনি ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই তিন অঙ্কের দেখা পেয়েছিলেন। আজ সে রেকর্ডে নাম লেখালেন মেয়ার্স। ওই যে, ‘এমন কিছু বাংলাদেশ দেখল ১৮ বছর পর।’

মেয়ার্স অবশ্য আরও অনেক কিছুই দেখতে বাধ্য করেছেন। এশিয়ায় কোনো ব্যাটসম্যানের অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি জ্যাক রুডলফের। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই সে কীর্তি গড়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান। তাঁর ২২২ রানের অপরাজিত ইনিংসটির কাছাকাছি কেউই যেতে পারেননি এত দিন। আজ বাংলাদেশের দেওয়া লক্ষ্যটা আরেকটু বড় হলে হয়তো মেয়ার্স সে চেষ্টা করতে পারতেন। তবু মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে এশিয়ার মাটিতে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডও কম নয়।

মেয়ার্স ও ডা সিলভার জুটি জয়ের পথে এগিয়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
ছবি: প্রথম আলো

এদিক থেকে তবু রুডলফ এগিয়ে আছেন। কিন্তু শুধু চতুর্থ ইনিংস হিসেবে নিলে কোনো দিক থেকেই মেয়ার্সের ধারেকাছে নেই কেউ। তাঁর রান যখন ১৪২, এমন অবস্থায়ই এক রেকর্ড ভাঙেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। আর সেটা হলো এশিয়ায় বাইরের কোনো ব্যাটসম্যানের চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড। ২০১৮ সালে দুবাইয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪১ রান করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার উসমান খাজা।

দিন যত এগিয়েছে, মেয়ার্সের রেকর্ডের তালিকা তত লম্বা হয়েছে। ধীরে ধীরে এশিয়ার মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ডগুলোও মুছে যেতে লাগল। ২০১৫ সালে পাল্লেকেলেতে চতুর্থ ইনিংসে ১৭১ রানের অপরাজিত ইনিংসে পাকিস্তানকে জয় এনে দিয়েছিলেন ইউনিস খান। এশিয়ায় চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ইনিংসের ইউনিসের রেকর্ডটি আজ জায়গা হারাল মেয়ার্সের ইনিংসের কাছে। এই প্রথম কেউ উপমহাদেশের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন। মেয়ার্সের যে এটি অভিষেক টেস্ট, এই মাপকাঠিও তাতে যোগ করতে হচ্ছে না।

সে সুবাদে বাংলাদেশের কপালেও জুটল আরও দুটি রেকর্ড। এশিয়ার মাটিতে এশিয়ায় বাইরের কোনো দলের কাছে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য দিয়ে হারার রেকর্ড বাংলাদেশেরই ছিল। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডকে ৩১৭ রানের লক্ষ্য দিয়েও হেরেছিল বাংলাদেশ। হারের এই তালিকায় দুই নম্বরেও আছে বাংলাদেশের নাম। ২০০৬ সালে ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচ। এখন থেকে শীর্ষ তিনেই থাকবে বাংলাদেশ।

অবশ্য শুধু এশিয়ার বাইরের দলের গণ্ডিতেই-বা আটকে থাকা কেন? এশিয়াতেই তো এশিয়ার কোনো দল এর আগে চতুর্থ ইনিংসে ৩৯৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে পারেনি। ২০১৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩৮৮ রানের লক্ষ্য পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। লক্ষ্যের চেয়ে ৩ রান বেশিই করেছিল লঙ্কানরা।

বাংলাদেশ যখন ৩৯৫ রানের লক্ষ্য দেয়, তখনই নিশ্চিত জানা ছিল, জিততে হলে এশিয়ার রেকর্ড গড়তে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। অসংখ্য রেকর্ড ভাঙা এক ইনিংসে মেয়ার্স সেটা নিশ্চিত করেছেন। এশিয়ায় সবচেয়ে বড় লক্ষ্য দিয়ে হারের রেকর্ডটি এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের।

ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য তাড়া করার রেকর্ডটি আগে থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছিল। ২০০৩ সালে রিকি পন্টিংয়ের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই সেই কাণ্ড করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। তাড়া করে ম্যাচ জেতার রেকর্ডের শীর্ষ পাঁচে উঠে গেল বাংলাদেশের নামও, তবে ‘প্রতিপক্ষ’ তালিকায়।