‘যখন আমার সময় আসবে, আবার অনেক রান করব’

তামিম ইকবালফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রথম দুই ম্যাচেই জিতে সিরিজ জয়ের আনন্দ, তৃতীয় ম্যাচে হেরে ১০ পয়েন্ট হারানোর দুঃখ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ নিয়ে বাংলাদেশ–অধিনায়ক তামিম ইকবালের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র।

শুভ্র: সিরিজ জয়ের আনন্দ নাকি শেষ ম্যাচে হেরে আরও ১০ পয়েন্ট পাওয়ার সুযোগ হারানোর দুঃখ—কোনটা আপনার কাছে বেশি বড়?

তামিম ইকবাল: অবশ্যই সিরিজ জয়ের আনন্দ।

শুভ্র: সিরিজ জয় তো প্রথম দুই ম্যাচেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, শেষ ম্যাচে আরও ১০ পয়েন্ট হারানোটাই কি তাহলে বড় হওয়ার কথা নয়?

তামিম: প্রথম ম্যাচটা যেভাবে জিতেছি, এরপর দ্বিতীয় ম্যাচটায় যেমন ভালো খেলেছি, তাতে আশা তো ছিলই যে শেষটাও আমরা ভালো করব। আমি আগেও অনেকবার বলেছি, এটা অন্য সিরিজের মতো নয়, প্রতিটা ম্যাচেরই এখানে আলাদা মূল্য আছে। ১০ পয়েন্ট হারানোটা তাই হতাশাজনক। তবে আপনার যে প্রশ্নটা ছিল, কোনটা আমার কাছে বড়, অবশ্যই সিরিজ জয়টা বড়।

আরও পড়ুন

শুভ্র: ৬ উইকেটে ৪৫ থেকে আফিফ আর মিরাজ যেভাবে প্রথম ম্যাচটা জিতিয়েছে, এটা তো অবশ্যই বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়গুলোর একটি। আপনার র‌্যাঙ্কিংয়ে এটা কোথায় থাকবে?

তামিম: সবচেয়ে স্মরণীয় জয়গুলোর একটা বলব না, আমি বলব, সবচেয়ে কঠিন জয়গুলোর একটি। শুধু আমি খেলেছি এমন ম্যাচগুলোর মধ্যেই না, টিভিতে দেখা ম্যাচ মিলিয়েও বলব, এ ধরনের ক্রিকেট ম্যাচ খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যদি অন্য কোনো ম্যাচের সঙ্গে তুলনা করতে বলেন, তাহলে বলব, ছোটবেলায় মাইকেল বেভানকে দেখেছি এমন কয়েকটা ম্যাচ জেতাতে। ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ওই বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষে আফিফ আর মিরাজের পারফরম্যান্সকে এককথায় আমি বলব অবিশ্বাস্য।

শুভ্র: এটাও কি এই সিরিজ থেকে আরেকটা প্রাপ্তি যে, আপনাদের সিনিয়র চার ক্রিকেটারকে ছাপিয়ে তরুণেরা ম্যাচ জয়ে বড় অবদান রেখেছেন...আফিফ, মিরাজ, লিটন, শরীফুল...

তামিম: অবশ্যই। দ্বিতীয় ম্যাচে মুশফিকের ইনিংসটা বাদ দিলে আমাদের তেমন কোনো কন্ট্রিবিউশন ছিল না। আফিফ দারুণ একটা ইনিংস খেলেছে, শরীফুল–তাসকিন ভালো বোলিং করেছে, মিরাজও তিনটা ম্যাচেই মোটামুটি ভালো বোলিং করেছে। তরুণেরা ম্যাচ জেতাচ্ছে, এটা দারুণ ব্যাপার।

তবে আমি কোনো সময়ই একটা সিরিজ বা দুইটা–তিনটা ম্যাচ দেখে চূড়ান্ত মতামত দিতে পছন্দ করি না। দুই সিরিজ, তিন সিরিজ, চার সিরিজে ভালো করলে তখন এটা আমাদের টিমের জন্য খুব ভালো হবে। এই সিরিজে যারা পারফর্ম করেনি, তাদের নিয়েও আমি মোটেই চিন্তিত না। আপনি যতই বড় প্লেয়ার হোন না কেন, একটা–দুটি সিরিজ খারাপ যেতেই পারে।

আফিফ–মিরাজের ব্যাটিংয়েই আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে রচিত হয় বাংলাদেশের রূপকথা
ছবি: শামসুল হক

শুভ্র: অধিনায়ক হিসেবে মোস্তাফিজের কাছে কি আপনার আরেকটু বেশি প্রত্যাশা ছিল?

তামিম: মোস্তাফিজ আমাদের নাম্বার ওয়ান ফাস্ট বোলার। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্নই নেই। তবে কখনো কখনো আমার মনে হয়, আমরা ওর কাছ থেকে একটু বেশি আশা করি। যে কারণে ও যখন নরমাল একটা পারফরম্যান্স করে, তা আমাদের পছন্দ হয় না।

শুভ্র: ঠিকই বলেছেন, মোস্তাফিজের কাছ থেকে সব সময় এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু চাই আমরা...

তামিম: সেটাই...কিন্তু কারও পক্ষেই তো প্রতি ম্যাচে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু করা সম্ভব না। মোস্তাফিজ কখন বল করে, সেটাও বুঝতে হবে। শুরুতে তিন–চার ওভার বল, মাঝখানে দুই ওভার, এরপর ডেথে চার–পাঁচ ওভার...তার মানে বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজটা করে মোস্তাফিজ।

কথার কথা, আমি যদি মোস্তাফিজকে মাঝখানে ৫–৬ ওভার করিয়ে শেষ করে দিই, তাহলে ওর ফিগার খুব ইকোনমিক্যাল থাকবে। ডেথে এসে মোস্তাফিজ ৭–৮ রান করে দিলেও আমরা বলব, ও ভালো করেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে আমরা হয়তো বলি, ও ৫০–৫৫ রান দিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয়, মোস্তাফিজ যে বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজটা করে, এটাকে আমাদের রেসপেক্ট করা উচিত।

শুভ্র: এই ওয়ানডে সিরিজটা চট্টগ্রামে হয়েছে নাকি আপনার কারণে...রশিদ আর মুজিবের স্পিন বেশি কার্যকর হবে বলে মিরপুরে খেলেননি, কথাটা কি ঠিক?

তামিম: আমি বলব, এটা টিম প্ল্যান। আমার মাথায় এসেছে, এটা নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেছি, মুশফিকের ইনপুটটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আপনি যদি দেখেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা এই প্রথম দেশে ঘাসের উইকেটে ওয়ানডে খেললাম।

আমি বলব না, এটা আমার একার সিদ্ধান্ত। কোচিং স্টাফ ছিল, অন্য ক্রিকেটাররা ছিল, বোর্ডের লোকজনও ছিলেন...এ কারণেই বলছি এটা ছিল টিম ডিসিশন। তবে এটা যদি অন্যদিকে চলে যেত, তাহলে হয়তো আমার দোষ হতো (হাসি)।

আমি কোনো সময়ই একটা সিরিজ বা দুইটা–তিনটা ম্যাচ দেখে চূড়ান্ত মতামত দিতে পছন্দ করি না। দুই সিরিজ, তিন সিরিজ, চার সিরিজে ভালো করলে তখন এটা আমাদের টিমের জন্য খুব ভালো হবে
তামিম ইকবাল, বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক

শুভ্র: এই সিরিজে অনেক দিন পর আপনাদের চার সিনিয়র ক্রিকেটারকে একসঙ্গে পাওয়া গেল, বোলিং আক্রমণটাকেও মনে হলো মোটামুটি সম্পূর্ণ...বাংলাদেশের সেরা ওয়ানডে দলের একটা রূপরেখা কি পেয়ে গেছেন?

তামিম: আমার মনে হয়, এখনো একটা–দুইটা জায়গা নিয়ে ভাবার আছে।

শুভ্র: যেমন ব্যাটিং অর্ডারে ৫ নম্বর...

তামিম: সেটা ৫ নম্বর হতে পারে, অন্য কোনো স্পটও হতে পারে। আমি নির্দিষ্ট করে আপনাকে বলতে চাচ্ছি না, শুধু উদাহরণ হিসেবে বলছি, যারাই ওই একটা–দুইটা স্পটে আছে, তারা এখনো নতুন।

কাজেই এখনই তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। যে একটা–দুইটা স্পট ঠিক করতে বাকি আছে, ওটা করতে পারলেই আমি আপনাকে বলতে পারব, হ্যাঁ, আমি আমার সেরা একাদশটা পেয়ে গেছি।

শুভ্র: ৫ নম্বরে অনেক দিন মোহাম্মদ মিঠুনকে চেষ্টা করা হয়েছে, এই সিরিজে ইয়াসির আলীকে। ৫ নম্বরটা যেহেতু একটা সমস্যা, কখনো কি আপনার মাথায় এসেছে যে আফিফকে পাঁচে খেলাই...

তামিম: হ্যাঁ, এসেছে। এ নিয়ে আলোচনাও করেছি। এখন দেখেন, আফিফকে যদি পাঁচে খেলাই, আমাকে ৭ নম্বরে কাউকে খুঁজে পেতে হবে। আফিফ সাতে ভালো করছে। আপনি আফিফকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবে, ও এর চেয়েও ভালো করতে চায়। আমরাও তা-ই চাই।

আমি সব সময় বলি, ছয়–সাত নম্বরে ব্যাটিং করা অনেক কঠিন। হয় আপনাকে গিয়েই মারতে হবে, নয়তো ইনিংস রিবিল্ড করতে হবে। রিয়াদ ভাই যে কাজটা অনেক দিন ধরে করছেন। আফিফ এখন যেখানে যেভাবে খেলছে, তাতে আমি খুশি। যদি ও নিয়মিত এমন ভালো পারফরম্যান্স করতে থাকে, টিম ম্যানেজমেন্ট বা আমার যদি মনে হয়, ওকে পাঁচে খেলানো উচিত, খেলবে। আমি তো বললাম, একটা–দুইটা স্পট এখনো আমাদের ঠিক দেওয়া করা বাকি।

শুভ্র: মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন কি বাংলাদেশের ওয়ানডে পরিকল্পনায় আছেন?

তামিম: অবশ্যই। ও আমাদের পরিকল্পনার খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বোলিংয়ের সঙ্গে ওর ব্যাটিংটাও আছে। যখন সুযোগ পেয়েছে, ভালোও করেছে। এখন ইনজুরির কারণে ও বাইরে আছে। যারা খেলছে, তারাও ভালো করছে। আমি বলব, এটা খুব স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

রুবেল হোসেন বাংলাদেশ দল থেকে ছিটকেই গেছেন
ছবি: প্রথম আলো

শুভ্র: আচ্ছা, রুবেল হোসেনের ঘটনাটা কী? দলের সঙ্গে এত দিন ঘুরলেন, ম্যাচের পর ম্যাচ বেঞ্চে বসে থাকলেন...তারপর হঠাৎ স্কোয়াডেই নেই!

তামিম: এই কথাটাতে আমার আপত্তি আছে। অনেক জায়গায় শুনছি যে রুবেল দলের সঙ্গে ঘুরছে, ঘুরছে, ঘুরছে...। আমাকে একটা জিনিস বলেন তো বিশ্বের কোন টিমে যে পাঁচজন বোলার দলের সঙ্গে যায়, তাদের সবাই খেলে? একজন–দুজন তো খেলে না। আপনি বাড়তি একজন–দুজনকে কী কারণে নিয়ে যান? কারও পারফরম্যান্স যদি খারাপ হয় বা কারও ইনজুরি হয়; তখন যেন আপনার হাতে বিকল্প থাকে।

শুভ্র: আমার প্রশ্নটা বসে থাকা নিয়ে নয়। প্রশ্ন হলো, কোনো একটা সিরিজে রুবেল যদি আপনার চতুর্থ বা পঞ্চম সেরা অপশন হয়; কোনো ম্যাচ না খেলেও পরের সিরিজে তিনি ১৫ জনের দলেও থাকবেন না কেন?

তামিম: আমি রুবেলকে দুর্ভাগা বলব। গত কিছুদিন ও সেভাবে খেলারই সুযোগ পায়নি। তবে যখনই খেলেছে, পারফর্ম করেছে। আমার কাছে মনে হয়, ইটস ভেরি আনফরচুনেট। তবে এটা আমার হাতে ছিল না।

শুভ্র: আপনি কি তাঁকে দলে চেয়েছিলেন?

তামিম: আমার মনে হয় কিছু কথা গোপন থাকাই ভালো।

শুভ্র: আপনার নিজের কথা বলুন, অমন ভালো একটা বিপিএলের পর এই সিরিজে নিজের পারফরম্যান্সে নিশ্চয়ই খুব হতাশ?

তামিম: অবশ্যই খুশি না। আমি খুব ভালো টাচে ছিলাম। বিপিএলটা আমার খুব ভালো গেছে...বিপিএলের চেয়ে বড় কথা হলো, আমি ভালো ব্যাটিং করছি। তিনটা ম্যাচ খারাপ গেছে, তার মানে এই না যে, আমি আউট অব ফর্ম।

আমি সব সময় বলি, অনেক দিন খারাপ খেলার পর একটা ইনিংস ভালো খেললেই কেউ ফর্মের চূড়ায় চলে যায় না; আবার দুই–তিনটা ইনিংসে রান না করলেই কেউ আউট অব ফর্ম হয়ে যায় না। এই সিরিজে রান করতে না পারায় আমি অবশ্যই হতাশ। তবে এটাই পৃথিবীর শেষ নয়। যখন আমার সময় আসবে, আমি আবার অনেক রান করব। এর আগেও যেমন করেছি।

ডন ব্র্যাডম্যান: ব্যর্থতার সঙ্গে যাঁর পরিচয় সামান্যই
ছবি: টুইটার

শুভ্র: ব্যর্থতাকে এমন সহজভাবে নেওয়াটা কি অভিজ্ঞতা থেকে আসে?

তামিম: অভিজ্ঞতা, মানুষের সাথে কথা বলে শেখা...আপনাকে একটা উদাহরণ দিই। ২০১৪ সালের দিকেই মনে হয়, আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল। তখন আমি কেভিন পিটারসেনকে জিজ্ঞেস করলাম, দেখো, আমি স্ট্রাগল করছি, এর থেকে বেরিয়ে আসতে কী করা উচিত।

তো ও আমাকে একটা সার্কেল এঁকে আমাকে বলল, ‘এই যে সার্কেলটা দেখছ, এর মধ্য দিয়ে শচীন টেন্ডুলকার ঘুরেছে, আমি ঘুরেছি, তুমিও ঘুরবে, বিশ্বের যত বড় প্লেয়ার আছে সবাইকেই ঘুরতে হবে। এই সার্কেলটা কেমন, জানো?’

আমি বললাম, কেমন? ও বলল, ‘তুমি ভালো খেলবে, খারাপ খেলবে, খুব ভালো খেলবে, খুব খারাপ খেলবে, আবার ভালো খেলবে, আবার খারাপ খেলবে। পৃথিবীতে কোনো ক্রিকেটার নাই, যে এই সার্কেলটা দিয়ে ঘোরে নাই। তুমিও ঘুরছ...এখন তুমি খারাপ খেলছ, এরপর ভালো খেলবে, এরপর আবার খারাপ খেলবে...এটা নিয়ে তাই দুশ্চিন্তা কোরো না।

শুভ্র: একমাত্র স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেই মনে হয় এই সার্কেলে ঘুরতে হয়নি...

তামিম: শেষ ম্যাচে উনিও শূন্য করেছেন না...(হাসি)

শুভ্র: তা ঠিক, প্রথম টেস্টে ব্যর্থ হওয়ার পর একবার ড্রপড–ও হয়েছিলেন। আচ্ছা, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান সম্পর্কে আপনার জানা–শোনা–বোঝা কেমন?

তামিম: আমি ছোটবেলা থেকে ওনার নাম শুনেছি স্যা–র ড–ন ব্র্যা–ড–ম্যান; নাইনটি নাইন পয়েন্ট কত যেন অ্যাভারেজ, শেষ ইনিংসে ৪ রান করলে হতো ১০০। ওনার সম্পর্কে বড় বড় কথাই শুনে আসছি, অতীতেও শুনেছি, এখনো শুনছি, ভবিষ্যতেও শুনব, আমার ছেলে যখন বড় হবে, সে–ও শুনবে। উনি এত বড় যে ওনার সম্পর্কে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ভাই। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নাই।

সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামীকাল...