মেহেদী মিরাজ

নাম

মেহেদী হাসান মিরাজ

জন্ম

২৫ অক্টোবর, ১৯৯৭

ধরন

অলরাউন্ডার

অভিষেক

বনাম শ্রীলঙ্কা, মার্চ ২৫, ২০১৭

তাঁর নিজের ইচ্ছেটা ছিল একটু অন্যরকম। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল আজন্মলালিত। সেই স্বপ্নটুকু ধরা পড়েছিল প্রয়াত শেখ সালাউদ্দিনের জহুরি চোখে। শেখ সালাউদ্দিন বলতে, বাংলাদেশের সাবেক অব-স্পিনার, যাকে বলা হতো সেই প্রজন্মের সেরা বাংলাদেশি অফ-স্পিনার। স্বপ্নের বাক্স গেল খুলে, তিনিও সেই বাক্স থেকে হিরে-জহরত-মণি-মুক্তা দু হাত ভরে নিতে থাকলেন। খুলনায় বেড়ে ওঠা মিরাজের বাংলাদেশের ‘মেহেদী হাসান মিরাজ’ হয়ে ওঠার সেটাই হলো শুরু।

২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রের শিরোনামে এলেন মিরাজ, বাংলাদেশ ওই বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে উঠেছিল সেমিফাইনালে। মিরাজের নেতৃত্বে সেবার ট্রফি জিততে না পারলেও হয়েছিল তৃতীয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটাও অর্জনের পাল্লায় কম কিছু ছিল না। দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল মিরাজের নেতৃত্ব, বেশি মুগ্ধতা ছড়াল অলরাউন্ড নৈপুণ্য। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে তুলনা হতে শুরু করল সাকিব আল হাসানের, যার সঙ্গে জুটি গড়েই এখন জাতীয় দলে খেলছেন নিয়মিতই।

ঘরোয়া ক্রিকেটে মিরাজের পা রাখা ২০১৪-১৫ মৌসুমে। তবে নজরকাড়া পারফরম্যান্স উপহার দিতে তাকে অপেক্ষা করতে হলো আরেকটা মৌসুম। বল হাতে তিনটি ইনিংসে পাঁচ উইকেটসহ মাত্র ১৬.৪৩ গড়ে তুলে নিলেন ৩০ উইকেট, আর এই পারফরম্যান্সই জাতীয় দলের দরজা খুলে দিল। মিরাজ ডাক পেলেন অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম টেস্ট সিরিজে।

অভিষেক হলো চট্টগ্রামে, নিজের জন্মদিনের মাত্রই কয়েকটা দিন আগে। টেস্ট আঙিনায় মাত্র একদিনের পদচারণাতেই অভিষেকটা রঙিন আলোয় রাঙালেন মিরাজ, প্রথম ইনিংস শেষে তাঁর নামের পাশে ৬ উইকেট লেখা হয়ে গেল। তাঁর চেয়েও বড় ব্যাপার, তিনি যেভাবে নিয়ন্ত্রিত লাইন লেংথে বল ফেলে বড় টার্নে ব্রিটিশ ব্যাটসম্যানদের নাকের জল চোখের জল একসঙ্গে করে ফেললেন। একজন অভিষিক্ত বোলার যখন নিজের এক স্পেলে টানা ১০ ওভার বোলিং করে ফেলেন, আর প্রতিটা বলই যখন ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে খেলতে বাধ্য করেন, বুঝতে হবে তাঁর স্নায়ু ধরে রাখার ক্ষমতা কতখানি।

আর এখানেই সাকিবের সঙ্গে আরেকবার মিল খুঁজে পাওয়া গেল মিরাজের। সাকিব বরাবরই শান্ত, অথচ অদম্য হিমালয়ের মতো অবিচল আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত। আর মিরাজের ক্ষেত্রে সম্ভবত এই ব্যাপারটি একেবারেই ঐশ্বরিক। চেহারার মধ্যে বালকসুলভ চপলতা যেমন ছিল, নিজের শক্তির জায়গাটাও খুব স্পষ্ট ছিল মিরাজের কাছে। ফলে তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না বিন্দুমাত্র। ফলাফল, বয়স ১৯ ছোঁয়ার আগেই মিরাজের নামের পাশে টেস্টে ফাইফার জমা পড়ল। তবে জেতাতে পারলেন না দলকে, ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে শেষ অবধি ম্যাচটা হারতে হলো ২২ রানে।

তবে তাতে থোড়াই কেয়ার মিরাজের। পরের ম্যাচে হয়ে উঠলেন আরও ভয়ংকর, দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংসে আরও দু’বার ছয়টি করে উইকেট সংগ্রহ করলেন। এই দফায় বাংলাদেশ চির অধরা জয়কে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাল, কুকের ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিল প্রথমবারের মতো! মিরাজ জিতলেন ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এবং ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ খেতাব।

২০১৭ সালে শততম টেস্ট জিতল বাংলাদেশ, দলকে দারুণ সংগত দিলেন মিরাজ। অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাটিতে পরিষ্কার ব্যবধানে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ, যথারীতি সেখানেও দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করলেন মিরাজ। বলাই বাহুল্য, দলের জন্য সে বছরটা ছিল রীতিমতো পয়মন্ত। আর দীর্ঘপরিসর ক্রিকেটে দারুণ পারফরম্যান্স তাকে সুযোগ এনে দেয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও।

শুরুটা অবশ্য খুব একটা সুবিধার হয়নি, অন্তত টেস্টের মতো বিধ্বংসী সূচনার ধারেকাছেও যায়নি সীমিত ওভারের পারফরম্যান্স। তবে মেহেদীও স্রেফ চুপচাপ বসে থাকা মানুষ নন, কাজ করতে শুরু করলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেট নিয়ে। কাজের ফলাফল চোখে পড়ল গত বিপিএলে, ব্যাটে-বলে-অধিনায়কত্বে মুগ্ধতা ছড়ালেন মিরাজ। সর্বশেষ এশিয়া কাপে সুযোগ পেয়ে প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র সময় নেননি তিনি, হয়ে উঠেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার অন্যতম ভরসা।

এই এশিয়া কাপটাও ছিল রীতিমতো দুঃসহ এক দুঃস্বপ্নেরই নামান্তর। একের পর এক ইনজুরিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে টাইগার শিবির। ইনজুরির থাবায় তামিম-সাকিবকে হারিয়ে দল হয়ে পড়ে দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে ওপেনিং জুটি হয়ে ওঠে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা, লিটন দাস কিংবা নাজমুল হোসেন শান্ত কেউই ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। ফাইনালে হঠাৎই একটা ফাটকা খেললেন মাশরাফি, মিরাজকে তুলে আনলেন ওপেনিংয়ে। ভোজবাজির মতো বদলে গেল খেলা, এই ম্যাচে ওপেনিং জুটি হলো শতরানেরও বেশি। তাতে লিটনের চোখ জুড়ানো ১২১ রানের কারণে কিছুটা ঢাকা পড়লেও মিরাজের স্থিতধী ৫৯ বলে ৩২ রান বাংলাদেশকে দিল লড়াই করার ভিত্তি। আরেকবার প্রমাণিত হলো, মিরাজ স্নায়ুচাপকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে জানেন।

এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিলেটে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে মিরাজ মাত্র ২৯ রান দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন চার উইকেট, যা দলকে পরিষ্কার ব্যবধানে জিততে সহায়তা করেছিল। এই ম্যাচ দিয়েই তিনি প্রমাণ করেন, যেকোনো ফরম্যাটেই তিনি দলের জন্য দারুণ এক সংযোজন হয়ে উঠতে পারেন। পরে নিদাহাস ট্রফিতে দারুণ সব স্পেল উপহার দিয়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও নিজেকে প্রমাণ করেন।

নির্ভুল লাইন লেংথই তাঁর বোলিংয়ের মূল অস্ত্র। বিশেষ করে পিচে স্পিনারদের জন্য বিন্দুমাত্র সাহায্য যদি থেকে থাকে, মিরাজ হয়ে ওঠেন অনবদ্য। বয়সটা নেহাতই কম, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খুব বেশি দিনের বিচরণ নয় তাঁর। উন্নতির এখনো ঢের বাকি তাঁর, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে। তবে কঠোর পরিশ্রমই যার মূলমন্ত্র, যিনি ক্যারিয়ারের শুরুতেই ‘ফোকাস না হারানো’র মতো বড় প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করতে জানেন, দুর্দান্ত ক্রিকেট মস্তিষ্কের উদাহরণ দিয়ে যিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পারফর্ম করতে জানেন।

তাঁর সামর্থ্যে বাজি রেখে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই বলে দেওয়া যায়, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১০ বছরে তিনিই হতে চলেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সুপারস্টার।

[সব তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত]