মাশরাফি-কোহলিরা কেন মেজাজ হারাচ্ছেন?
তিনটি ঘটনা তিন জায়গায়, তিন অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনে। তবুও কী দারুণ মিল! তিন অধিনায়কেরই ‘সফট টার্গেট’ হয়েছেন সাংবাদিক। তাঁরা মনের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাংবাদিকের ওপর।
প্রথম ঘটনাটা গত নভেম্বরে ইন্দোর টেস্টে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ে বাংলাদেশ দল। ব্যাটিং বিপর্যয় হতেই পারে। কিন্তু ভারতীয় বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এত ভীত দেখাল কেন? বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক দায় চাপালেন সাংবাদিকদের ওপর, ‘...আপনারা এমনভাবে সব প্রশ্ন করেন, যেমন ধরুন রশিদ খান আছে, সেটা বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকেন। আপনি যতই সেটা চিন্তা না করতে চান, আপনাকে ভাবিয়ে তুলবেই...।’
দ্বিতীয় ঘটনা এই কদিন আগে সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের আগে। সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘যেসব প্রশ্ন আপনার কাছে আসে, তা অনেকটা আত্মসম্মানের। যে জায়গাটায় এখন দাঁড়িয়ে আছেন, বিশেষ করে ৮ ম্যাচে উইকেট নেই। ২০০১ সালে যখন শুরু করলেন নভেম্বরে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে, ওয়ানডে খেললেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শুরু হয়েছিল, ফ্লাওয়ার-ব্রাদার্সের উইকেট নিলেন। ২০০৭-০৮ সালে তিন–চারটা ম্যাচে আপনি উইকেট পাননি, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আপনাকে পড়তে হয়নি। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে বলেই কি একটা বাড়তি মোটিভেশন কাজ করছে, আপনার যদিও মোটিভেশনের দরকার পড়ে না।’
দীর্ঘ এ প্রশ্নের যে উত্তরটা মাশরাফি দিলেন, সেটিতে যেন কাঠগড়ায় উঠতে হলো প্রশ্নকর্তাকেই, ‘আত্মসম্মান বা লজ্জা, আমি কি চুরি করি মাঠে? আমি কি চোর? খেলার সঙ্গে লজ্জা, আত্মসম্মান আমি মেলাতে পারি না। এত জায়গায় এত চুরি হচ্ছে, চামারি হচ্ছে, তাদের লজ্জা নাই? আমি মাঠে এসে উইকেট না পেলে আমার লজ্জা লাগবে। আমি কি চোর?’
তৃতীয় ঘটনাটা মাশরাফির সংবাদ সম্মেলনের ঠিক পরের দিন। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে হেরে ধবলধোলাই নিশ্চিত হয়েছে ভারতের। ম্যাচ শেষে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, খেলার সময় প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ফেরানোর পর কোহলি যেসব ভঙ্গি করেছেন, সেটি ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে সঠিক আচরণ কি না? উত্তর দিতে গিয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে কড়া কথাবার্তাই বিনিময় হয়ে গেল তাঁর। উত্তর দেবেন কী, কোহলি উল্টো জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী মনে করেন, সেটাই শুনি...আপনার বের করা উচিত আসলে কী হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে ভালো প্রশ্ন করা। ঘটনাটা পুরোপুরি না জেনে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি আপনার...।’
তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে, তিন ভিন্ন অধিনায়কের এ তিনটি ঘটনা দেখে মনে হতে পারে সাংবাদিকদের সঙ্গে বুঝি ক্রিকেটারদের মরু মেরু দূরত্ব! আসলেই কি তা–ই? কোহলির সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দূরত্ব থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সব সময়ই সুসম্পর্ক থাকে বলে মনে করেন সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র, ‘খেলোয়াড়-সংগঠকদের সঙ্গে আমাদের দেশে সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্কটা একটু বন্ধুর মতো হয়ে যায়। তবে নিজের সমালোচনা কেউই পছন্দ করে না। মাশরাফির ক্ষেত্রে যেটা মনে হয়েছে, তিনি যে প্রশ্নে অমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, সেটি মাশরাফিসুলভ নয়। ২০ বছর ধরে যে মাশরাফিকে চিনি, তাতে খুবই অবাক হয়েছি। আর মুমিনুল দিয়েছিলেন হালকা অজুহাত। সাংবাদিকের কাজই তো এটা। আলোচিত বিষয় তুলে ধরা। অপ্রিয় প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা। কোহলির আগেও সাংবাদিকদের সঙ্গে টুকটাক লেগেছে। মাঝে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডে ভরাডুবির কারণে হয়তো আবার সেটা হয়েছে।’
অথচ মাশরাফির ওরকম উত্তরের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা নানা আলোচনায় ‘খলনায়ক’ বনে যান প্রশ্নকর্তা। কিন্তু পর্দার পেছনের গল্পটা হচ্ছে, সংবাদ সম্মেলনের পর মাশরাফি নিজেই ওই সাংবাদিককে ফোন করে ঝাঁজাল উত্তর দেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটারের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্কটা আসলে এ রকমই উষ্ণ। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। উৎপল শুভ্র যে বললেন ‘উত্তরটা ঠিক মাশরাফিসুলভ নয়।’ প্রায় ২০ বছরের ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে কেন এ বিস্ফোরণ ঘটল অধিনায়কের কণ্ঠে? কিংবা ভীষণ চুপচাপ আর সংবাদমাধ্যমবান্ধব মুমিনুলই–বা কেন ব্যাটিং বিপর্যয়ের দায় চাপালেন সাংবাদিকের ওপর? ১৫০ কোটি মানুষের চাপ সামলানো কোহলি কেন পারেননি মেজাজ ধরে রাখতে?
সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকর আতহার আলী খান বলছেন, বিষয়টা পুরোই মনস্তাত্ত্বিক, ‘একজন খেলোয়াড় অনেক সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানসিকভাবে যতই শক্ত থাক, সুন্দর ব্যাটিং করতে করতে একটা বাজে শট খেলে ফেলার মতো ভুল হয়ে যায়। তার কাজ হচ্ছে খেলা। কিন্তু ছোট ছোট অনেক বিষয় মাথায় জড়ো হয়ে যায়। পরে যেটির বিস্ফোরণ ঘটে এভাবে।’
উৎপল শুভ্রও বলছেন একই কথা। চারদিক ধেয়ে আসা নানা আলোচনা, সমালোচনা, বারবার একই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া—সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য চাপ অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে একজন ক্রিকেটারকে। আর তাতে ভেঙে পড়েন মাশরাফির মতো ভীষণ শক্ত খেলোয়াড়ও, ‘তার চারপাশে যে নানা কথাবার্তা হচ্ছে, এটার চাপে মাশরাফি এভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তার উত্তরটা প্রশ্নের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পর্কিত নয়। চাপ এমন জিনিস তাতে মাশরাফিও ভেঙেও পড়েন। মাশরাফি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছি। এত দিন তাকে যেভাবে দেখছি, নেতিবাচক কিছু লেখা হলেও কখনোই তিনি এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান না।’
ক্রিকেটারদের এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল মনোবিদ মোহিত কামালের কাছে। তিনিও হতাশা আর চাপে নুয়ে পড়ার কথাই বললেন, ‘হতাশা থেকেই আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি হয়। যে উদাহরণগুলো এখানে আসছে, প্রত্যেকে যে আক্রমণাত্মক উত্তর দিয়েছে, সেটি হয়েছে হতাশা থেকে। মাশরাফি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও তাঁর বয়স বেড়েছে। এখন তিনি সাংসদ হওয়ায় অনেক টিপ্পনী, কথা, সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। ছোট ছোট দুঃখ-হতাশা তাঁর ভেতরে জমা হয়েছে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। কোহলির হতাশা তৈরি হয়েছে ধবলধোলাই থেকে। হতাশা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা দুর্বল বা কম হলেই এমনটা হয়ে থাকে।’
কথায় আছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে সাংবাদিকেরা হচ্ছেন ‘নেসেসারি ইভিল’। যাঁরা সব সময়ই অন্যায়-ভুল-অসংগতি তুলে ধরে যন্ত্রণা দেন, কিন্তু তাঁদের এড়িয়ে চলা যায় না। ব্রায়ান লারা একবার বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, সাংবাদিকেরা ‘আনন্যাসেসারি ইভিল’! ক্যারিবীয় কিংবদন্তি মুখে যতই বলুন, আধুনিক ক্রিকেটে এই অপরিহার্য অংশকে কি তিনিও কখনো এড়িয়ে চলতে পেরেছেন? কন্ডিশন কঠিন হতেই পারে। তাই বলে সেটিকে তো এড়িয়ে চলা যায় না। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই বরং বড় ক্রিকেটারের গুণ।