মাশরাফিকে মোস্তাফিজের 'উপহার'
>মাশরাফিকে সবচেয়ে বড় বিদায়ী অভ্যর্থনাটি দিলেন অবশ্য মোস্তাফিজুর রহমান। এজবাস্টনে গত ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট পেয়েছেন। কাল পাকিস্তানের বিপক্ষেও ৫ উইকেট
‘মাশরাফি তুমি লাল-সবুজের ভালোবাসা।’ ‘আওয়ার ক্যাপ্টেন, আওয়ার প্রাইড মাশরাফি।’
বাংলাদেশের তরুণ শৈশব আহমেদ লন্ডনে থাকেন। মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রচণ্ড ভক্ত। বিশ্বকাপে মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে প্রিয় ক্রিকেটারের জন্য কিছু একটা করতে চাইলেন শৈশব। কাল লর্ডসে বানিয়ে আনলেন ও রকম স্লোগান লেখা দুই হাজার প্ল্যাকার্ড। কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশি দর্শকদের মধ্যে বিতরণ করলেন সেগুলো। দর্শকেরা সেই প্ল্যাকার্ড হাতে মাশরাফির প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলেন গ্যালারিতে।
মাশরাফি মাঠেও পেলেন বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ী ‘অভ্যর্থনা’। সেটি কতভাবেই! এই ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল কালই প্রথম লাল জার্সি পরে খেলল। লাল মাশরাফির প্রিয় রং বলেই জানে সবাই। তবে লাল রঙের ‘অ্যাওয়ে’ জার্সি বাংলাদেশ পরেছে ঘটনাচক্রে। পাকিস্তানের জার্সিও সবুজ বলে বাংলাদেশের ভাগ্যে পড়ে অ্যাওয়ে জার্সি খেলে পরার দিন। তাতে লাল জার্সি আর সবুজ ট্রাউজারে পরিপূর্ণ হলো বাংলাদেশ।
মাশরাফিকে সবচেয়ে বড় বিদায়ী অভ্যর্থনাটি দিলেন অবশ্য মোস্তাফিজুর রহমান। এজবাস্টনে গত ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট পেয়েছেন। কাল পাকিস্তানের বিপক্ষেও ৫ উইকেট। তামিম ইকবাল ও শাহাদাত হোসেনের পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে নাম তুললেন লর্ডসের ড্রেসিংরুমে থাকা অনার্স বোর্ডে। তবে ওয়ানডের কৃতিত্ব দিয়ে তাতে নাম ওঠানো বাংলাদেশি ক্রিকেটার মোস্তাফিজই প্রথম। আগে শুধু টেস্টে সেঞ্চুরি করলে আর ৫ উইকেট পেলে অনার্স বোর্ডে নাম উঠত। এ বছর থেকে ওয়ানডের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ারও ক্যানভাস হয়ে গেছে সেটি।
মোস্তাফিজ সেই ক্যানভাসে ভাসিয়ে তোলা প্রথম বাংলাদেশি নাম। এই বিশ্বকাপে এ রকম একটা কিছু তাঁর প্রাপ্যই ছিল। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে নানা কারণে সাকিবের পারফরম্যান্সই বেশি আলোকিত। কালকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জেতা তিন ম্যাচেই তাঁর অবদান ভালোভাবে দৃশ্যমান। সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারলে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের দাবিও জানাতে পারতেন জোর গলায়। কিন্তু ভালো বোলিং করেও মোস্তাফিজ থেকে যাচ্ছিলেন সাকিবের ছায়ায়, পর্দার আড়ালের নায়কের মতো। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে তিনি যে পরিমাণ আলোচনায়, আগের ম্যাচগুলোতে সে তুলনায় মোস্তাফিজের নামও ঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতার পর সাকিব-লিটনকে নিয়ে উচ্ছ্বাস-প্রশংসা আড়াল করে দেয় ‘আনসাং হিরো’কে। অধিনায়ক মাশরাফিই একমাত্র বলেছিলেন, ‘ম্যাচটা আসলে ঘুরিয়ে দেয় মোস্তাফিজই।’ কারণ একই ওভারে হেটমায়ার ও আন্দ্রে রাসেলের উইকেট দুটি তিনি তুলে না নিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান যে কোথায় যেত, কে জানে!
দুই স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসান নিয়ন্ত্রিত বোলিং করবেন, সেটি নতুন কিছু নয়। কিন্তু লর্ডসের কিছুটা সবুজ উইকেটে দুই পেসার মোস্তাফিজ আর মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনই আসল কাজটা করে দেন। সাইফউদ্দিনের ৮.৫৫ এবং মোস্তাফিজের ৭.৫ ইকোনমি রেট দেখে মনে হতেই পারে যে দুজন মিলে রান তো কম দেননি! মাঝেমধ্যে লাইন-লেংথ একটু এদিক-সেদিক হওয়াতেই এটি হয়েছে। কিন্তু তাঁদের উইকেটগুলো দেখুন। বাবরকে এলবিডব্লু করে ইমাম-উল-হকের সঙ্গে তাঁর ১৫৭ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটিটা ভাঙেন সাইফউদ্দিন। ঠিক ১০০ করে ইমাম-উল-হক অবশ্য স্টাম্পে পা লাগিয়ে হিট উইকেট, কিন্তু সেটিও তো মোস্তাফিজকে ব্যাকফুটের ওপর ভর করে ফ্লিক করার চেষ্টা করতে গিয়েই।
পাকিস্তান ৯ উইকেটে ৩১৫ রান করে ফেলার পরও বোলারদের প্রশংসাটা বেশি বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই উইকেটে ৩১৫ রান খুব বড় কিছু নয়। সেটিও পাকিস্তান করেছে অনেকটা ভাগ্যগুণে। ইমাম-উল-হক বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচ আগেই সেঞ্চুরি করা বাবর আজম ফেরেন ৯৬ রান করে। তবু পাকিস্তানের রানের সঙ্গে ভাগ্যের সম্পর্ক খোঁজার কারণ, ইনিংসের ২৭তম ওভারে এই দুই ব্যাটসম্যানই পেয়েছেন যুগল জীবন। প্রথমে ইমাম-উল-হক। মোসাদ্দেকের তৃতীয় বলটা ড্রাইভ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচের মতো দেন পাকিস্তান ওপেনার। উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমের গ্লাভস ফাঁকি দিয়ে বল চলে যায় থার্ডম্যানের দিকে। দৌড়ে ৩ রান নিয়ে ওই বলেই ফিফটি ইমাম-উল-হকের।
নড়বড়ে নব্বইয়ে আউট হওয়া বাবরের ফিফটি হয়ে গিয়েছিল তারও আগে। ওই ওভারেই যখন আউটের সুযোগটা দিলেন, তখন তাঁর রান ৬১। ১৯৯২ বিশ্বকাপে জাভেদ মিয়াঁদাদের করা ৪৩৭ রান টপকে হয়ে গেছেন এক বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যান। মোসাদ্দেকের বল বাবরের ব্যাটের কানায় লেগে আঘাত করে মুশফিকের বাঁ হাঁটুতে। আগের দিন কনুইতে পাওয়া চোট সামলে মুশফিক যে কাল ম্যাচ খেলেছেন, সেটাই হয়তো বেশি। কিন্তু এই পর্যায়ের ক্রিকেটে এ ধরনের ক্যাচ ছাড়ার আসলে কোনো অজুহাত হয় না। বাবরকে ৬১ বা ইমাম-উল-হককে ৪৫ রানে ফেরাতে পারলে পাকিস্তানের স্কোর ১ উইকেটে ১২৩ থেকে হয়ে যেতে পারত ৩ উইকেটে ১২৭-১২৮ রান। অথচ জুটিটা ভাঙল কিনা ১৮০ রানে! গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়েও ব্যর্থতা ছিল, বাংলাদেশের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো প্রামাণ্যচিত্র বানালে অনেক ভালোর পাশে সেসবও থাকবে চাঁদের কলঙ্কের মতো।