বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুটটা মাথায় পরে নিউজিল্যান্ড নিশ্চয়ই অতীতের অনেক কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছে। সাউদাম্পটনে বিরাট কোহলির ভারতকে কাল ৮ উইকেটে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড এখন ক্রিকেটের সবচেয়ে ধ্রুপদি সংস্করণের ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’।
এটি কেবল একটি জয়ই নয়, এটি ক্রিকেটীয় চেতনা, কঠোর পরিশ্রম আর দিনে দিনে দারুণ একটা দল গড়ে তোলার পুরস্কারও। ক্রিকেট পণ্ডিতেরা তাই এখন কিউইদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা যেভাবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জিতল, সেটি তাদের প্রাপ্যই।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের মতে, নিউজিল্যান্ডের এই জয় দলটির দুর্দান্ত ধারাবাহিক পারফরম্যান্সেরই পুরস্কার, ‘এটা বিশ্ব পরিসরে একটা দুর্দান্ত দলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স।’
তিনি কেইন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটীয় চেতনাবোধেরও প্রশংসা করেছেন, ‘উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা “বিনয়ী” একটা দল তৈরি করেছেন, তাতে তারা নিউজিল্যান্ডবাসীরও অনুপ্রেরণা।’
কাল সাউদাম্পটনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের রোমাঞ্চ নিউজিল্যান্ডর মানুষ উপভোগ করেছেন গভীর রাতে। চোখে ঘুম নিয়ে, জেগে বসে তাঁরা সাক্ষী হয়েছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের অসাধারণ এক গৌরবের। পরপর দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে হারের সেই দুঃসহ যন্ত্রণাবোধ প্রতিটি কিউই ক্রিকেটপ্রেমী মাথায় রেখেই দেখছিলেন ম্যাচটি। ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার। এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল ইংল্যান্ডের কাছে সুপার ওভারে হৃদয় ভেঙে দেওয়া সেই হারটা মনে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলেও এবার আর হতাশ করেননি কেইন উইলিয়ামসের বাহিনী।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলকে অভিনন্দিত করেছে তাদের রাগবি দলও। রাগবিতে তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ড। নিজেদের অফিশিয়াল টুইটার পেজে উইলিয়ামসনদের অভিনন্দন জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে রাজকীয় শিরোপাটা জেতায় আপনাদের অভিনন্দন। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল বড় করেই দেখেছিল স্বপ্নটা। আপনারা গোটা দেশের মানুষকে গর্বিত করেছেন।’
ফাইনালে নিউজিল্যান্ড এমন একটা দলকে হারিয়েছে, সেই ভারতের ক্রিকেট বোর্ড আর্থিকভাবে কতটা এগিয়ে আছে, সে ব্যাপারটিও উঠে এসেছে নিউজিল্যান্ডের মানুষের ভাবনায়। অনেকেই বলেছেন, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের বার্ষিক রোজগারের সঙ্গে উইলিয়ামসনদের আয়ের যে পার্থক্য, সেটি মোটামুটি বিশাল। কেউ কেউ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই জয়কে রূপকথার সেই বিখ্যাত ডেভিডের গোলিয়াথ–বধের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাঁদের চোখে ভারতকে ‘গোলিয়াথ’ আর নিউজিল্যান্ড ‘ডেভিড’।
নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও টিভি ধারাভাষ্যকার সাইমন ডুলের মতে, ‘এই জয়টা ডেভিডের গোলিয়াথ–বধের মতোই এক গল্প। কেইন উইলিয়ামসনরা ভারতকে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতায় প্রমাণ করে যে অনেক সময় ছোট্ট, চুপচাপ ধরনের কেউ জয়ী হয়ে দেখাতে পারে।’
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের এ জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। তিনি মনে করেন জয়টা নিউজিল্যান্ডের প্রাপ্যই ছিল, ‘বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতায় অভিনন্দন নিউজিল্যান্ড দলকে। যোগ্যতর দল হিসেবেই নিউজিল্যান্ড শিরোপা জিতেছে।’
আরেক সাবেক ভারতীয় গ্রেট ভিভিএস লক্ষ্মণেরও একই মত, ‘যোগ্যতর দল হিসেবে জেতায় নিউজিল্যান্ডকে অভিনন্দন। তাদের বোলাররা এ ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছে। উইলিয়ামসন আর রস টেলরের মতো অভিজ্ঞরা নিজেদের অভিজ্ঞতাকে জয় পেতে কাজে লাগিয়েছেন।’
ক্রিকেট মাঠে এখন সবাই আগ্রাসনের পক্ষে কথা বলেন। সব দলই আগ্রাসী, মেজাজি হতে চায়। প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে জিততে চায় যেকোনো মূল্যেই। উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড এই জায়গায় আশ্চর্য ব্যতিক্রম। কিন্তু ক্রিকেটের সেরা সংস্করণের শিরোপাটা নিজেদের করে নিয়ে নিউজিল্যান্ড প্রমাণ করেছে, ভদ্রভাবে খেলে, মাঠে খেলোয়াড়ি মনোভাবের সর্বোচ্চটা দিয়েও এখন ম্যাচ জেতা যায়। অর্জনগুলোকে বাড়ানো যায়। নিউজিল্যান্ডেরই সাবেক ক্রিকেটার মার্ক রিচার্ডসন কথা বলেছেন এটি নিয়েই, ‘একসময় অস্ট্রেলিয়া যেভাবে ক্রিকেট মাঠে ঔদ্ধত্য আর অভদ্রতার নজির তৈরি করে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে জিতত, নিউজিল্যান্ড দলটা তেমন নয়। বরং সচেতনভাবে ক্রিকেটীয় চেতনাকে আবারও ফিরিয়ে আনার কাজটা কিউইরা করেছে। কিন্তু ভালো ক্রিকেটটা কিন্তু ঠিকই তারা খেলছে।’
নিউজিল্যান্ডের এই জয় এক অর্থে ক্রিকেটীয় চেতনারও!