ভারতের ক্রিকেটে জালিয়াত চক্রের খোঁজ, জড়িত আইপিএলের ক্রিকেটার
ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের গুরগাঁও পুলিশের কাছে গত জুলাইয়ে অভিযোগটি করেন উত্তর প্রদেশের ক্রিকেটার আনসুল রাজ। গুরগাঁওয়ের সিকিউর স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক আশুতোষ বোরার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন তিনি।
১০ লাখ রুপির বিনিময়ে তাঁকে সি কে নাইড়ু টুর্নামেন্টে হিমাচল প্রদেশের অনূর্ধ্ব–২৩ দলে জায়গা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আশুতোষ বোরা—আনসুল রাজ পুলিশের কাছে এই অভিযোগ করেন।
পুলিশের তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ জানিয়েছে, এই জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত তিনটি রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন কর্মকর্তা, একজন সন্দেহভাজন জুয়াড়ি, দিল্লি ক্রিকেটে নির্বাচকদের সাবেক আহ্বায়ক, আইপিএল দলের ক্রিকেটার এবং বেঙ্গল অনূর্ধ্ব–১৯ দলের এক ক্রিকেটার। এর পাশাপাশি সেই স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান তো আছেই।
ভারতীয় ক্রিকেটে এ ঘটনা বেশ তোলপাড় ফেলেছে। ভারতের অফ স্পিনার হরভজন সিং টুইট করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। ‘ক্যাশ ফর সিলেকশন’ নামে সাড়া ফেলা এ ঘটনা আসলে জালিয়াত চক্রের টাকা কামানোর কৌশল। তরুণ ক্রিকেটারদের টাকার বিনিময়ে দলে জায়গা পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়।
৫ সেপ্টেম্বর গুরগাঁও পুলিশ বোরার অফিসে অভিযান চালায়। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পুলিশ সেখানে কিছু ‘চুক্তিপত্র’ উদ্ধার করে। মোট ১৮ জন ক্রিকেটারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বোরার প্রতিষ্ঠান।
এর পাশাপাশি ফোনালাপ, হোয়াটসঅ্যাপ–বার্তা ও টাকার হদিসের সঙ্গে বোরার যোগসূত্র পাওয়ার পর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় বোরার সহযোগী হিসেবে বেঙ্গল অনূর্ধ্ব–১৯ দলের ক্রিকেটার দানিশ মির্জাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ গত সপ্তাহে অভিযোগনামা তৈরি করে। দিল্লি, উত্তরাখন্ড ও অরুণাচল প্রদেশের ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের নোটিশও পাঠায় পুলিশ। এই তিন রাজ্যের যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নোটিশ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
একজন জানান, কাজের জন্য বোরার কাছ থেকে তিনি অগ্রিম টাকা পেয়েছিলেন, কিন্তু পরে ফেরত দিয়ে দেন। অন্য দুজনের দাবি, বোরার নাম তাঁরা কখনো শোনেননি। চতুর্থজন বলেছেন, তাঁর ‘মেয়াদ শেষ’ হওয়ায় এখন দল নির্বাচনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
বোরার সঙ্গে তাঁর বোন চিত্রাকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চিত্রা সেই ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দুজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছাড়াও আরও কিছু ধারায় অভিযোগ গঠন করেছে পুলিশ।
অতীতে ভারতের বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে দুর্নীতির খবর পাওয়া গেলেও কোনো ম্যানেজমেন্ট ফার্মের এর সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মনে করছে, এ ঘটনায় প্রমাণ হয়, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে দুর্নীতিবাজেরা জোটবদ্ধ এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপকর্ম করা শুরু করেছেন।
পুলিশের সূত্র মারফত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জেনেছে, বোরার ব্যাংক বিবরণীর আর্থিক লেনদেনের হিসাবের সঙ্গে দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক সঞ্জয় ভরদ্বাজের যোগসূত্র রয়েছে।
তাঁর ব্যাংক হিসাব থেকে ভরদ্বাজের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া অরুণাচল প্রদেশের সহসভাপতি নাবাম ভিভেকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠানেও আশুতোষ বোরার ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
ভরদ্বাজ অভিযুক্তের কাছ থেকে টাকাটা কেন পেয়েছিলেন, তা ব্যাখ্যা করেননি। শুধু এটুকু বলেছিলেন, খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতারণা নিয়ে তাঁর ‘কোনো ধারণা নেই।’ নাবাম ভিভেক জানান, একাডেমি বানাতে মাঠের জন্য তাঁকে টাকাটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি সব ভেস্তে দেওয়ার পর টাকা তিনি ফেরত দেন। বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও ডেকেছে পুলিশ।
আইপিএলে একবার মুম্বাই ইন্ডিয়ানস দলের সঙ্গে ছিলেন জাভেদ খান। তরুণ ক্রিকেটারদের আকর্ষণ বাড়াতে জাভেদ খানকে ‘সাইনবোর্ড’ হিসেবে ব্যবহার করেছে সেই ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান।
দিল্লির সাবেক লিগ ক্রিকেটার সোবার্স জোবানের সঙ্গে এ ঘটনার যোগসূত্রও খুঁজছে পুলিশ। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘সান’–এর গোপন ভিডিওতে প্রথম আলোচনায় আসেন সোবার্স জোবান। সেবার অ্যাশেজের ‘পাতানো’ মৌসুমের নানা তথ্য বেচে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি ভিডিওতে। পুলিশ সোবার্সকে এখনো খুঁজে পায়নি।
তাঁর বাবা বলজিৎ একজন ক্রিকেট কোচ। তিনি জানান, জোবান রাশিয়াতে ছিলেন। পাতানো খেলার সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ। এরপরই পুলিশ তাঁকে অনুমতি দেয়।
অভিযোগপত্রে আনসুল রাজ জানিয়েছেন, বোরা তাঁকে সিকিম দলে জায়গা পাইয়ে দেওয়ার লোভও দেখিয়েছেন। তিনি আরও জানান, দিল্লির হয়ে টি–টোয়েন্টি খেলা জাভেদ খানও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
আইপিএলে একবার মুম্বাই ইন্ডিয়ানস দলের সঙ্গে ছিলেন জাভেদ খান। তরুণ ক্রিকেটারদের আকর্ষণ বাড়াতে জাভেদ খানকে ‘সাইনবোর্ড’ হিসেবে ব্যবহার করেছে সেই ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। সেখানেই নাকি জাভেদ খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল—জানান আনসুল রাজ।
গুরগাঁও পুলিশের অর্থনৈতিক বিভাগ জানিয়েছে, তথ্য–প্রমাণ যা মিলেছে, তাতে নোটিশপ্রাপ্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ রয়েছে। এদিকে আশুতোষ বোরার আইনজীবী রাও ভগত সিংয়ের দাবি, ‘আমার মক্কেলের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং তাঁকে ব্ল্যাকমেল করতে এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়েছে।’