ভারতে ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ধর্মীয় জাতপাতের ভেদ
মানুষে মানুষে জাতপাতের ভেদই একধরনের বর্ণবাদ। খেলার মাঠকে সেটি থেকে দূরে রাখার একটা জায়গা বলেই ভাবা হয়।
খেলার মাঠে সবাই খেলোয়াড়, সেখানে গায়ের রং, ধর্ম, জাত, বর্ণ, দেশ, জাতি—কোনো কিছুই ভেদাভেদ করে না, এটাই খেলার মাঠের চেতনা। কিন্তু ভারতে এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যা হচ্ছে, তাতে এই চেতনাই প্রশ্নবিদ্ধ।
হায়দরাবাদে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছে শুধু হিন্দুধর্মীয় একটি বিশেষ বর্ণের মানুষকে নিয়ে। টুর্নামেন্টের নিয়মে বলা আছে, ওই বর্ণ ছাড়া আর কোনো বর্ণের মানুষ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারবেন না।
পরিচয়পত্র দেখিয়ে বর্ণ প্রমাণের নিয়মও রাখা হয়েছে! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই টুর্নামেন্টের পোস্টার ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে চারদিকে চলছে সমালোচনা।
আয়োজকেরা অবশ্য বলছেন, এটা হিন্দুধর্মের অন্য কোনো বর্ণ কিংবা অন্য কোনো ধর্মের প্রতিও বিদ্বেষ থেকে করা হয়নি।
টুর্নামেন্টটা আয়োজন করা হয়েছে শুধু মন্দিরের কাজে নিয়োজিত মানুষের বিনোদনের একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
১৩৫ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতে ক্রিকেট উন্মাদনা এত বেশি যে ক্রিকেট রোমান্টিকরা সেখানে ক্রিকেটকেও একটা ধর্ম হিসেবে অভিহিত করেন। সেখানে এভাবে শুধু একটি নির্দিষ্ট বর্ণের মানুষের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন ভালোভাবে দেখা হচ্ছে না।
২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর হয়ে যাওয়া টুর্নামেন্টটির একটি পোস্টার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে একটি নিয়ম লেখা আছে, ‘প্রত্যেক খেলোয়াড়কে অবশ্যই প্রমাণ হিসেবে তাঁদের আইডি কার্ড দেখাতে হবে এবং অন্য কোনো বর্ণের খেলোয়াড় এতে খেলতে পারবেন না।’
পোস্টারে খেলার তারিখ উল্লেখ ছিল ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর, তবে খেলা পরে এক দিন পিছিয়ে গেছে বলে জানাচ্ছে ভারতীয় পত্রিকা নিউ কেরালা।
কিন্তু ২০২০ সালে এসেও বর্ণের ভিত্তিতে কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজিত হবে, এ ব্যাপারটাই মানতে পারছেন না অনেকে। টুর্নামেন্টটা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে হয়েছে বলে জানাচ্ছে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম, যে কারণে টুইটারে স্থানীয় প্রশাসনকেও ধুয়ে দিয়েছেন অনেক ভারতীয়।
নিজেদের চোখে একটি ভুলের সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ অবশ্য এখানেও বাড়াবাড়ি করছেন। আয়োজকেরা মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আইএএনএসের কাছে।
‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মন্দিরের কাজে নিয়োজিত মানুষকে বিনোদনের জন্য ক্রিকেট খেলার সুযোগ করে দেওয়া। তাঁরা সাধারণত কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারেন না। সে কারণে আমরা তাঁদের একটা প্ল্যাটফর্ম করে দিতে চেয়েছিলাম’—চারদিকে সমালোচনার জবাবে টুর্নামেন্ট আয়োজনের ব্যাখ্যায় আইএএনএসে বলেছেন আয়োজকদের একজন সাই সানকেথ, যিনি একজন এমবিএ পড়ুয়া ছাত্র।
টুর্নামেন্টটি হয়েছে ১৪ দলের। সব দলের সব খেলোয়াড়ই ছিলেন কোনো না কোনো মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এতে সব বয়সেরই খেলোয়াড় ছিলেন বলে জানাচ্ছেন আয়োজকেরা। কয়েকজনের বয়স নাকি ৫০ বছরের বেশিও ছিল!
টুর্নামেন্টটা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়নি বলে দাবি করছেন সানকেথ, ‘এটা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আয়োজিত ছোট্ট একটা টুর্নামেন্ট ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু মানুষ এটাতে বর্ণ, জাতপাত জড়িয়ে এটাকে রং চড়াচ্ছে। তারা এটাকে জড়িয়ে সংঘাত তৈরির চেষ্টা করছে।’
তাঁরা কোনো বর্ণের বিরুদ্ধে নন বলেও জানালেন সানকেথ, ‘এটার উদ্দেশ্য শুধু ছিল যাঁরা অন্য টুর্নামেন্টগুলোতে খেলতে পারেন না, তাঁদের এখানে খেলার সুযোগ করে দেওয়া। আমরা কোনো জাত কিংবা কোনো ধর্মেরও বিরুদ্ধে নই। (খেলোয়াড়েরা শুধু একটি নির্দিষ্ট বর্ণের হলেও) আয়োজকদের মধ্যে সব বর্ণ ও ধর্মের মানুষই আছেন।’
টুর্নামেন্ট এক দিন পেছানোর কারণ হিসেবে বললেন, ‘আমরা ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খ্রিষ্টান একজন বন্ধুর অনুরোধে আমরা টুর্নামেন্টটা এক দিন পিছিয়েছি।’
বর্ণ-জাত প্রমাণে আইডি কার্ড দেখানোর নিয়ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। ভারতে জাতের পার্থক্য নির্ধারক সনদ দেওয়া হয় জানিয়ে সেটি নিয়েও এত হইচইয়ের কিছু দেখছেন না সানকেথ, ‘সরকারই তো জাত নির্ধারণ করা সনদ দেয়। এখন কোনো একজন মানুষের সনদ থাকা মানে কি তিনি অন্য জাত-বর্ণের বিরোধী?’
আর টুর্নামেন্টটা এবারই প্রথম আয়োজিত হচ্ছে না বলে জানালেন সানকেথ। আয়োজিত হয়েছিল গত দুই বছরও।
তবু প্রশ্ন উঠছে, মন্দিরের কাজে নিয়োজিতদের বিনোদনে আয়োজিত টুর্নামেন্টে জাত দিয়ে বিভাজন না করে মন্দিরে কাজ করার প্রমাণই তো চাওয়া যেত!