গায়ানায় এলে আপনাকে হাতছানি দেবে আমাজন জঙ্গল। মানচিত্রটা সামনে মেলে ধরলে মনে হবে, সীমানা পেরোলেই তো ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, সুরিনাম। যাই না একটু ঘুরে আসি...! পর্যটকদের একঝলক আমাজন দেখিয়ে আনার বিভিন্ন প্যাকেজও আছে এখানে।
কিন্তু আপনি যদি ক্রিকেট কাভার করতে আসা সাংবাদিক হয়ে থাকেন, ব্যাপারটা ‘যাই না একটু ঘুরে আসি’–জাতীয় পরিকল্পনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। ভ্রমণঝক্কি আর আসা–যাওয়ায় যে দিনগুলো খরচ হয়ে যাবে, তাতে আপনার আসল কাজটাই তো ঠিকমতো হবে না। হ্যাঁ, সিরিজ শেষ হলে সেই পরিকল্পনা হাতে নেওয়াই যায়।
আসল কাজটা যে এমনিতেও খুব ভালো হচ্ছে, সেটিই–বা বলি কী করে! টেস্ট সিরিজ থেকেই তো খেলার রিপোর্টের সঙ্গে প্রতিদিন একটু একটু করে আবহাওয়া সাংবাদিকতাও করছি। বৃষ্টিতে খেলা থেমে যাচ্ছে, অনুশীলন বাতিল হচ্ছে; মাঝখানে আবার সেন্ট লুসিয়ায় সাইক্লোনের দাপাদাপিও হলো।
বলতে পারেন খেলা নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা, চাইলে তো ব্রাজিল–আমাজন ঘুরে আসা যায়ই। বলা যত সহজ, করা ততই কঠিন। খেলা না হলেও প্রেসবক্সে বসে আপনাকে খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, অনুশীলন না হলেও মাঠে একপাক ঘুরে আসতে হবে এবং বৃষ্টি হলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে বৃষ্টি থামার জন্য। অখণ্ড ছুটি বলে বিদেশ সফরে কিছু নেই। একটু অবসরেও মস্তিষ্কে ‘ঝিঁঝিপোকা’ ডাকতে থাকবে। আর খেলা হলে তো সকাল থেকে সন্ধ্যা মাঠেই কাটাও। এটাই বিদেশে ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করতে আসার জ্বালা।
লেখার মধ্যে একটা আবহাওয়ার ‘বিশেষ বুলেটিন’ দিয়ে নেই। এই লেখা যখন লিখছি, গায়ানার রাজধানী জর্জটাউনে সময় বুধবার রাত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে আসলে সেই বিকেল থেকেই। সন্ধ্যার সময় তো বেশ ঝাপিয়েই হলো। পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার ম্যাচের সময়ও বজ্রসহ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজ তৃতীয় টি–টোয়েন্টির ভবিষ্যৎ তাই একটু ঘোলাটেই মনে হচ্ছিল।
গায়ানার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এর আগে লিখেছিলাম জর্জটাউনের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর আপনাকে ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেবে। সঙ্গে এ দেশের মানুষের সঙ্গে যদি মেশেন, তাদের জীবনযাপন দেখেন, তাহলে মনে হতে পারে, এ তো আসলে ভারতবর্ষই!
ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানার যোগাযোগ ঐতিহাসিক। বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত জানতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ২০০ বছর আগে। গায়ানা তখন ব্রিটিশ কলোনি। দাসপ্রথার সময় আখচাষি হিসেবে এবং চিনিকলগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করাতে ব্রিটিশরা প্রচুর আফ্রিকান মানুষ এ দেশে নিয়ে আসে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর চিনিকলগুলোতে কাজ করতে আসতে থাকে ভারতীয়রাও। ১৮৩৮ সালের ৫ মে ভারতীয়দের নিয়ে প্রথম জাহাজটি ভেড়ে তৎকালীন ব্রিটিশ গায়ানায়। কলকাতা থেকে আসা সেই জাহাজে ছিলেন ৩৯৬ যাত্রী।
তখন থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জাহাজে চড়ে আড়াই লাখের মতো ভারতীয় গায়ানায় এসেছেন। এক হিসাবে সেখান থেকে মাত্র ৭৫ হাজারের মতো মানুষই পরে ফিরে গেছেন ভারতে। বাকিরা রয়ে গেছেন আটলান্টিক পাড়ের দেশটিতে। মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের এই মানুষগুলোই বংশপরম্পরায় গড়ে তুলেছেন ইন্দো–গায়ানিজ জনগোষ্ঠী। বর্তমানে গায়ানার জনগোষ্ঠির ৪৪ শতাংশই ইন্দো–গায়ানিজ। দেশটিতে এরপরই আধিপত্য ভারতীয়দেরও আগে এখানে আসা আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের (প্রায় ৩০ শতাংশ)।
তো যে দেশের ৪৪ শতাংশ মানুষের শরীরেই ভারতীয় রক্ত বহমান, সেই দেশের মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, আচার–আচরণ—সবকিছুতে ‘ভারত’ ফুটে ওঠাটাই তো স্বাভাবিক। ভারতীয় সংগীতের কথা তো আলাদা করেই বলতে হয়।
ক্যারিবীয় অন্যান্য দেশের মতো ক্যালিপসো আর র্যাগে মিউজিক এ দেশেরও ঐতিহ্য। তবে জর্জটাউনের রাস্তায় ছুটে চলা গাড়িগুলোতে বা বার–রেস্টুরেন্টে উঁচু ভলিউমে বাজতে থাকা গানে আপনি খুঁজে পাবেন ভারতীয় টান। পুরোনো হিন্দি গান অথবা হিন্দি গানের সুরে রিমেক করা গায়ানিজ সংগীত। অনেক গায়ানিজ গানের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়া হিন্দি গানের কলি যেন জানিয়ে দিতে চায়, গায়ানার শিরায় শিরায় আসলে ভারতীয় সংস্কৃতিরই উপস্থিতি।
১৯৩০–এর দশকে ভারতে ‘বলিউড মুভি’র রিল চলতে শুরু করে এবং ওই সময়েই গায়ানায় চালু হয় রেডিও। শুরু থেকেই হিন্দি গান সেগুলোর প্রাণ। এখনো এফএম রেডিওতে সারাক্ষণ হিন্দি সুরের গানই বাজে। তবে হিন্দি গান এখানে এসেছে আরও আগে, সেই চিনিকল আর আখ চাষের কাজ করতে জাহাজে চড়ে আসা ভারতীয়দের সঙ্গে। ভারতীয়দের নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট গ্রামগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই চলে এসেছে হিন্দি সিনেমার হিট মিউজিক, ভারতীয় লোকসংগীত আর বিয়ের গান। এরপর সেসব ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গায়ানায়। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে ব্যাপক।
আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এসে ভারতীয়রা বংশপরম্পরায় ধরে রেখেছেন নিজেদের সংস্কৃতি। হিন্দি গানের কথা তো বলাই হলো। সঙ্গে কত্থক নৃত্য আর তবলা শেখানোর স্কুল, হিন্দি ভাষায় লেখা দোকান–রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড, খাবারের দোকানের শোকেসে সাজিয়ে রাখা পেড়া–সন্দেশ আর সমুচা, এখানকার মানুষের নাম; রাজধানী জর্জটাউনে একটা দিন ঘুরে বেড়ালে মনে হবে—আপনি ভারতের কোনো শহরেই আছেন। গায়ানা যেন আরেক ‘ভারতীয় দেশ’।
এ দেশে ভারতীয়দের প্রথম আসার দিন ১৯৩৮ সালের ৫ মে। এখনো প্রতিবছর উৎসবমুখরতায় পালিত হয় দিনটি। ৫ মে সরকারি ছুটির দিনও। প্রায় ৮ শতাংশ মুসলমানের এ দেশে অবশ্য ঈদেও সরকারি ছুটি আছে। ঈদের ছুটিতে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর ব্যবসা–বাণিজ্য বন্ধ থাকে। এবার যেমন এখানে ঈদুল আজহা পালিত হবে ৯ ও ১০ জুলাই।
ভাববেন না সেই ছুটিতে আমাজন যাওয়া যাবে। গায়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শুরুই হবে ১০ জুলাই। কাজেই ঈদের ছুটিটাও কাটবে খেলা নিয়ে, ইন্দো–গায়ানিজ চাটনি–মিক্স মিউজিক শুনে এবং অবশ্যই এত কাছে এসেও আমাজন না দেখার আফসোস নিয়ে।