ভারতকে ধুয়ে দিলেন ইনজামাম

আহমেদাবাদের উইকেটের সমালোচনায় ইনজামাম।ছবি: এএফপি

আর ২৪ ঘণ্টাও বাকি নেই চতুর্থ টেস্ট শুরু হওয়ার। কত সমীকরণ জড়িয়ে আছে আহমেদাবাদে হতে যাওয়া সে টেস্টে। ভারত জিতলে জুনে হতে যাওয়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তারা খেলবে। আর ইংল্যান্ড জিতলে ভারত নয়, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে সে ফাইনালে খেলবে অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু ওসব সমীকরণ কিংবা চতুর্থ টেস্টে কী হতে পারে সেটির বিশ্লেষণ নয়, ক্রিকেট দুনিয়া এখনো যেন পড়ে আছে আহমেদাবাদেই হয়ে যাওয়া ভারত-ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেস্ট নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে টেস্টটার উইকেট নিয়ে।

দুই দিনের মধ্যে শেষ হয়েছে সেই টেস্ট, গত ৫৪ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে যা আর দেখা যায়নি। ১০ উইকেটে টেস্টটা জিতে চার টেস্টের সিরিজে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে ভারত। কিন্তু যেরকম স্পিনসহায়ক উইকেট বানিয়ে ভারত ইংল্যান্ডকে বশ করেছে, সেটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হচ্ছে না। এবার সে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক। ভারতকে রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন ‘ইনজি।’ উইকেটের অবস্থা বোঝাতে টেস্টের তৃতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান জো রুটের অবিশ্বাস্য বোলিং কীর্তি টেনে এনে বললেন, রুট যদি এই উইকেটে ৫ উইকেট পান, তাহলে এই উইকেটে ভারতের দুই স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর অক্ষর প্যাটেলের প্রশংসা করার কি আছে?

বড় খবরের শিরোনাম হয়েই শুরু হয়েছিল আহমেদাবাদের ভারত-ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেস্টটা। মোতেরা স্টেডিয়ামকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়েছে ভারতের সরকার, দর্শক ধারণক্ষমতায় যেটি এখন ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। টেস্ট শুরুর আগে স্টেডিয়ামটার নাম মোতেরা থেকে বদলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নামেও করা হয়েছে। কিন্তু এত আয়োজনের পর স্টেডিয়ামটাতে পাঁচ দিনের টেস্ট শেষ হয়ে গেল মাত্র দুদিনে! পিচ নিয়ে আলোচনা তো হবেই।

মাইকেল ভন, ডেভিড লয়েডদের ইংল্যান্ডের সাবেকরা ভারতের এমন পিচ বানানো নিয়ে সমালোচনায় মুখর। আবার ভারতের সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটাররা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বিদেশে গেলে ভারতকে যখন পেস-সহায়ক পিচে খেলতে হয়, তখন এত আলোচনা কেন হয় না? ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস আবার ভারতের এমন উইকেট বানানোয় কোনো সমস্যা দেখেন না।

আলোচক-সমালোচকের সারিতে নিজের নামটিও লিখিয়ে নিলেন ইনজামাম। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক কিছু প্রশ্ন রেখেছেন, ‘কেউ ভাবতে পারেনি (দুই দিনে টেস্ট শেষ হবে)। আমিও মনে করতে পারি না শেষ কবে একটা টেস্ট ম্যাচ দুই দিনে শেষ হয়ে গেছে! এখানে ভারত খুব ভালো খেলেছে নাকি উইকেটের আচরণের কারণে এমনটা হয়েছে? এমন উইকেট কি টেস্টে রাখা উচিত?’ অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারত দারুণ ক্রিকেট খেলেছে জানিয়ে পরে প্রশ্নগুলোর উত্তর ইনজামাম নিজেই দিয়েছেন, ‘ভারত দারুণ ক্রিকেটই তো খেলছিল। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, (প্রথম টেস্টে হারের পর) দ্বিতীয় টেস্টে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ রকম একটা উইকেট বানানো? আমার মনে হয় না ক্রিকেটে এমন কিছু করা ঠিক হচ্ছে।’

আহমেদাবাদে দাঁড়াতেই পারেনি ইংল্যান্ড।
ছবি: বিসিসিআই

আইসিসিকে এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত জানিয়ে ‘ইনজি’ বললেন, ‘এমনকি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের স্কোরকার্ডও তো আহমেদাবাদে টেস্টে আমরা যা দেখেছি তার চেয়ে ভালো হয়। আইসিসির এখানে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এটা কেমন উইকেট যেখানে একটা টেস্ট পুরো দুটি দিনও টিকতে পারে না? এক দিনেরও কম সময়ে ১৭ উইকেট পড়ে যায়...কী ধরনের খেলা হচ্ছে এখানে? অবশ্যই সবাই নিজের মাঠের সুবিধা নিতে চাইবে, স্পিনসহায়ক উইকেট বানানোতেও সমস্যা নেই, কিন্তু তাই বলে পিচ এমন হতে পারে না।’

ঘরের মাঠের সুবিধা নেওয়ার প্রসঙ্গে ১৯৯৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের একটা টেস্টের স্মৃতিও টেনে এনেছেন ইনজামাম, ‘একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে আমার মনে হয় এমন ক্রিকেট খেলার কোনো মানে হয় না। উপমহাদেশে কোনো দল এলে তাদের স্পিন-সহায়ক উইকেটের মুখোমুখি হতে হবে, কিন্তু তাই বলে এতটা? আমার মনে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে চতুর্থ ইনিংসে উইকেট এত অসমান ছিল! ভারতের জয়ের জন্য ১০০-১২৫ (১২০ রান) রানের মতো দরকার ছিল এবং তারা অলআউট হয়ে গেল (৮১ রানে)। সে সময় সেই উইকেট নিয়েও অনেক শোরগোল হয়েছিল।’

এমন উইকেট বানানোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, ক্রিকেটটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না। এভাবে উইকেট বানানোর রীতি চালু হয়ে গেলে স্বাগতিক দলগুলোর জেতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে, যেটা শেষ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটকেই রসকষহীন বানিয়ে ফেলতে পারে। এমন উইকেটে একজন ক্রিকেটারের দক্ষতার পুরোটা দেখা যায় না বলেই মানেন অনেকে। ইনজামামও সেই প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন আহমেদাবাদে দ্বিতীয় দিনে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড অধিনায়ক জো রুটের বল হাতে চমকের কথা। সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রুট সেদিন ৮ রানে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট! ক্যারিয়ারে এর আগে ৯৪ ইনিংসে বল হাতে নিয়ে একবারই ২ উইকেটের বেশি পেয়েছিলেন রুট, গত বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে।

স্পিনাররা হয়ে উঠেছিলেন ‘ঘাতক’।
ছবি: বিসিসিআই

রুট নিজেই সেদিন ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, ‘আমার পাঁচ উইকেট পাওয়াই বলে এই উইকেটটা কেমন ছিল।’ ইনজামামও সেই সুরেই বলেছেন, ‘জো রুট যদি ৬ ওভারে ৫ উইকেট পায়, উইকেটের কন্ডিশন কী ছিল, সেটা তো বোঝাই যায়।’ টেস্টে দুই ইনিংসে ইংল্যান্ডের ১৮ উইকেট নেওয়া ভারতীয় দুই স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও অক্ষর প্যাটেলেরও তাই প্রশংসা করতে রাজি নন ইনজামাম, ‘আমি কেন আর অশ্বিন আর অক্ষর প্যাটেলের প্রশংসা করব যেখানে রুট ৮ রানে ৫ উইকেট পায়? একটা টেস্ট ম্যাচে কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার থাকে—ভেন্যু, মাঠ, আম্পায়ার, রেফারি...। পিচেরও এখানে একটা বড় ভূমিকা থাকবেই। একটা টেস্ট ম্যাচকে টেস্ট ম্যাচের মতো হতে হবে। আমার মনে হয় না ভারত এই জয়ে (আহমেদাবাদ টেস্ট) অত তৃপ্তি পেয়েছে, যেটা তারা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে পেয়েছে।’