বনফায়ার উৎসবের রাতে গাভাস্কারের অভিনন্দন
আতহার আলী খান ঘুরে ঘুরে সবাইকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দেখাচ্ছিলেন। বার্তা প্রেরকের নাম সুনীল গাভাস্কার।
বার্তায় কী আছে, সেটি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। কাল রাতে গাভাস্কার আতহারকে লিখেছেন, ‘অসাধারণ অর্জনের জন্য বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন, যে বাংলাদেশের ক্রিকেটটা শুরু হয়েছিল তোমাদের হাত ধরে। দলের খেলোয়াড়দেরও আমার অভিনন্দন পৌঁছে দিয়ো।’
সেঞ্চুরিয়নের আফ্রিকান প্রাইড আইরিন লজের বিশাল খাবার ঘরে ততক্ষণে চিকেন বিরিয়ানি আর ভাত-পাবদা মাছের স্বাদে ভেজানো নৈশভোজটা শেষের ঢেকুর তুলছে। এক টেবিলে আড্ডায় মেতে উঠেছেন এই সিরিজেই দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড আর ফিল্ডিং কোচ শেন ম্যাকডারমট।
পাশের টেবিলে প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর সঙ্গে স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ আর নির্বাচক হাবিবুল বাশারের গল্প। দেয়ালে ঝোলানো বড় টেলিভিশনে চলছে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ ওয়ানডের ধারণ করা খেলা। আড্ডা-গল্পের ফাঁকে সবাই চোখ রাখছেন সেদিকে। তবে যেসব টেবিলে হইচইটা উঁচু, টেলিভিশনের পর্দার দিকে আগ্রহটা যেন তাদেরই বেশি!
একটা বল উঠে গেল আকাশের দিকে। ক্যাচ নেওয়ার জন্য তৈরি ইয়াসির আলী। এরপর কী হয়েছে, সবাই তো জানেনই, ম্যাচে দুর্ভাগ্যবশত ইয়াসির ক্যাচটা নিতে পারেননি। কিন্তু যে খেলাটা কয়েক ঘণ্টা আগে নিজেরাই মাঠে খেলে এসেছেন, সেটি যেন এই প্রথম দেখছেন তামিম-মুশফিকরা! উত্তেজনার পারদ আকাশে তুলে দিয়ে সবাই হই হই করে উঠলেন—না জানি ক্যাচটা মিস হয়ে যায়!
ম্যাচের এ রকম আরও কিছু খণ্ডচিত্রে ক্রিকেটারদের খণ্ড খণ্ড আগ্রহের প্রকাশ যেন সেঞ্চুরিয়নের সিরিজ জয়ের ম্যাচকেই নতুন করে সামনে নিয়ে এল। নাটকের কুশীলবেরাই যখন কৌতূহল নিয়ে নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করেন, তখন সেটি তো নতুন আরেকটা নাটকই!
শুধু ‘নাটক’ না বলে ‘রূপকথার নাটক’ বলা বোধ হয় আরও ভালো। ‘অসাধারণ একটা ম্যাচ জিতলেন’ প্রশংসা বাক্যের জবাবে তামিম ইকবাল নয়তো কেন বলবেন, ‘আসলে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। চিমটি কেটে দেখতে হবে...।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটা ম্যাচ না হয় হারানো যায়। কিন্তু তিন ম্যাচের সিরিজের দুটি ম্যাচই দোর্দণ্ড প্রতাপে জিতে বাংলাদেশ সিরিজটাই ২-১–এ জিতে নেবে, এ যে রূপকথাকেও হার মানায়! কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ দল মাঝেমধ্যেই জয়ের দেখা পাচ্ছে বলে হয়তো জয়টা অনেকের চোখ সওয়া হয়ে গেছে।
এটা তাদের মনে হতেই পারে, এ আর নতুন কি! বাংলাদেশ তো বড় দলকে হারায়ই।
কিন্তু যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাঠে এবারের আগে বাংলাদেশ কখনো একটা ম্যাচও জেতেনি, মাত্রই দুই মাস আগে ভারতের মতো দলকে ঘরের মাঠে যারা ৩-০ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে, টেস্ট সিরিজ জিতেছে ২-১ ব্যবধানে; সেই একই শক্তির দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশের সামনে এভাবে ধসে পড়বে, এ যে সত্যিই বিস্ময়কর!
নির্বাচক হাবিবুল বাশার যেন তখনো ঘোরের মধ্যে, ‘অবিশ্বাস্য! একটা ম্যাচ জিতলে ফ্লুক বলতে পারতেন। দুইটা ম্যাচ...! বিশেষ করে আজকের (গতকাল) জয়টা তো সব দিক দিয়েই অসাধারণ।’ কেন অসাধারণ, সেই ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে পারেন টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের কথায়, ‘ছেলেরা বোলিং ভালো করেছে ঠিক আছে, কিন্তু এরপর আমরা ব্যাটিংটাও তো দারুণ করলাম। ১৫৪ রানের ম্যাচেও কিন্তু অনেক সময় অতিসাবধানী হতে গিয়ে বিপদে পড়তে হয়। আজ সেটা হয়নি। তামিম-লিটন ওদের বোলারদের কোনো সুযোগই দেয়নি।’
জয়ের উপকরণের তালিকায় আরও আছে তামিম ইকবালের বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব। যখন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটারই ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা গেছে মাঠে। প্রশংসা শুনে তামিম যদিও বিব্রত হন, তবু অগ্রজ ও টিম ম্যানেজার নাফিস ইকবালের কথায় তাঁর মুখে আর ভাষা আসে না, ‘তুই আজ যেটাই করেছিস, সেটাতেই সফল হয়েছিস। বোলিংয়ের পরিবর্তনগুলোর প্রায় সব কটিতেই তো উইকেট এসেছে।’ ক্রিকেটারদের মানসিকতার পরিবর্তনটাও সবার মুখে মুখে। হার-জিত দুটিকেই স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার মানসিকতার সবচেয়ে বড় শক্তি—যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস।
জয়ের রাতে বাংলাদেশ দলের আবহে যখন কেবলই সুখের আনাগোনা, তখন সেঞ্চুরিয়নের প্রেসবক্স আর তার আশপাশে কান পাতলেই শোনা গেছে একটা প্রোটীয়-আক্ষেপ। আইপিএলের দিকে ক্রিকেটারদের মনোযোগ সরে যাওয়াতেই নাকি সিরিজ হারের সর্বনাশ! কিন্তু তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কী? এ রকম অনেক সর্বনাশের রাত পার করেই তো কাল এল উৎসবে ভাসার রাত, যার শেষটা টিম হোটেলের লেকের পাড়ে বনফায়ার উৎসবে, যেখানে আমুদে আতহার আলীর নৃত্যের সঙ্গে অলংকার হয়েছে সুনীল গাভাস্কারের অভিনন্দন বার্তাও।