বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে তিনি ভাবলেন, ব্র্যাডম্যানের সঙ্গেই থাকবেন
দুই যুগ! এ সময়ের ব্যবধানে মানুষ কত কিছু ভুলে যায়। কিন্তু পেশোয়ার টেস্টে মার্ক টেলরের ৩৩৪* হয়তো এখনো মনে আছে অনেকের। টেস্টে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংস ছুঁয়ে ফেলার পর আর এগোননি অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক।
পূর্বসূরি কিংবদন্তিকে সম্মান দেখিয়ে নিজে ৩৩৪ রানে অপরাজিত থাকার পরও ইনিংস ঘোষণা করেছিলেন টেলর। দীর্ঘ ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়া দল এবার আবার পাকিস্তান সফরে যাওয়ায় টেলরের ইনিংসটি ফিরে ফিরে আসছে আলোচনায়।
টেলরের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ পাকিস্তান সফর করেছিল অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তা শঙ্কায় মাঝের এ সময়ে আর পাকিস্তান সফর করা হয়নি তাদের। দুই যুগ আগের সেই সফরের সময়েও খুব স্বস্তিতে থাকতে পারেননি টেলর–স্লাটাররা।
ফক্স ক্রিকেটের প্রতিবেদন পড়ে জানা যায়, সেবার পাকিস্তান সফরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা বিনোদন বলতে শুধু লোকজন থেকে দূরে গিয়ে পিৎজা–বিয়ার খেতে পেরেছেন। পেশোয়ার টেস্টের আগে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের বিয়ার সরবরাহ করেছিল ব্রিটিশ হাই কমিশন। খেলার বাইরে আমেরিকান ক্লাবে গিয়ে খানিকটা আমোদ–ফুর্তি করতে পেরেছেন টেলররা।
পেশোয়ার টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে এই আমেরিকান ক্লাবেই বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে একটি সিদ্ধান্ত নেন টেলর। পরে সেই সিদ্ধান্ত ক্রিকেটে তাঁর ভাবমূর্তিকে চিরস্থায়ীভাবে একটি অনন্য জায়গায় স্থান করে দেয়।
দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে ৩৩৪ রানে অপরাজিত ছিলেন টেলর। বিদেশের মাটিতে এমন স্কোর এমনিতেই অনেক বড় কিছু, কিন্তু টেলর ভেবেছেন অন্যভাবে। এটা তো ব্র্যাডম্যানেরও টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো অস্ট্রেলিয়ান তাঁকে টপকে যেতে পারেননি।
১৯৩০ সালে হেডিংলি টেস্টে ব্র্যাডম্যান ৩৩৪ রান করার পর এ সময়ের মধ্যে শুধু বব সিম্পসন (৩১১) ও বব কুপার (৩০৭) তাঁর ধারেকাছে যেতে পেরেছিলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, টেলর তাঁকে টপকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও বিয়ারের ক্যানে অলস চুমুক দিতে দিতে তাঁর পাশেই থেমে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। অর্থাৎ, ইনিংস ডিক্লেয়ার!
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জয়ের পর পেশোয়ারে টস জিতে ব্যাটিং নেন টেলর। তত দিনে তাঁর ক্যারিয়ার গোধূলি দেখছে, তেমন রানের মধ্যেও ছিলেন না। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তখনো তাঁর প্রয়োজন ফুরায়নি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) কাছে। ব্যাটিংয়ে নেমে তাঁর শুরুটাও তেমন স্বস্তিদায়ক ছিল না।
টেলরের সতীর্থ মার্ক ওয়াহর ভাষায়, ‘প্রথম ঘণ্টায় তাঁর ব্যাটিং দেখে মনে হয়নি ৩৩৪ রান করে ফেলবে। শোয়েব আখতার প্রথম সেশনে খুব জোরে বল করছিল। কাজটা খুব কঠিন ছিল।’ ব্যক্তিগত ১৮ ও ২৭ রানে জীবন পেয়ে অর্ধশতকের দেখা পান টেলর। এরপর বাকি পথে আর কোনো ভুল হয়নি।
ইনিংসটি খেলার একপর্যায়ে দুটি বিষয় ভেবেছেন টেলর, ব্র্যাডম্যানের রেকর্ডটি মাথায় আনবেন না। দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে ইনিংস ঘোষণা করবেন অথবা তাঁকে টপকে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি। দ্বিতীয় দিনে খেলা শেষ হওয়ার দুই বল বাকি থাকতে টেলর ৩৩৪ রানে ব্যাট করার সময় ইনিংস ঘোষণার ভাবনাটা বাতিল করেন।
শেষ দুই বলের প্রথমটি ছিল ফুল টস, মিড অনে সোজা ইজাজ আহমেদের কাছে খেলেন। পরেরটি স্কয়ার লেগে দারুণ ফিল্ডিংয়ে রুখে দেওয়ায় ব্র্যাডম্যানকে আর টপকাতে পারেননি। তবে মার্ক ওয়াহ মনে করেন, টেলর সেই বিকেলে ব্র্যাডম্যানকে টপকানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই সে রেকর্ডটি ভাঙতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনোভাবে হয়নি।’
পরদিন রেকর্ডটি ভাঙার চেষ্টা করবেন কি না, এ নিয়ে দোটানায় ভোগায় রাত দুইটা পর্যন্ত টেলর ঘুমোতে পারেননি। সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলেন এ নিয়ে। হিলি জানিয়ে দেন, ‘আমাদের বোলিং করা দরকার।’ আমেরিকান ক্লাব থেকে বের হয়ে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন টেলর, ‘আমার বোন ও বড় ছেলে উইল বলেছিল “ব্যাট করো, বোকার হদ্দ।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে হয় এবং ইনিংস ঘোষণাই যৌক্তিক মনে হয়েছে।’
তৃতীয় দিন সকালে টেলর ইনিংস ঘোষণার পর ওয়াহ একটু অবাক হলেও হিলি টের পেয়েছিলেন আগেই। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে টেলর নিজেই লিখেছেন, ‘ততক্ষণে ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রানের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছি। লোকে ভাবতে পারে, তাকে টপকে যেতেই আমি ইনিংস ঘোষণা করিনি।’
অস্ট্রেলিয়ায় ফেরার পর ব্র্যাডম্যানের দাওয়াত পেয়েছিলেন টেলর। অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যানের বাসায় দুজনে মিলে নিজেদের ৩৩৪ রানের স্মৃতি ভাগাভাগি করেন। ব্র্যাডম্যানেরই বেশি গর্ব অনুভব করার কথা। কেউ শুধু তাঁর জন্য, শুধু তাঁকে সম্মান জানাতে আর ব্যাট করেনি...।