বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটরের পছন্দ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি

কলকাতায় গোলাপি টেস্টের পর আশিস ভৌমিককে (ডানে) স্মারক গোলাপি শার্ট উপহার দেন বিসিসিআই প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলী। মাঝে সিএবি সেক্রেটারি অভিষেক ডালমিয়া। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতায় গোলাপি টেস্টের পর আশিস ভৌমিককে (ডানে) স্মারক গোলাপি শার্ট উপহার দেন বিসিসিআই প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলী। মাঝে সিএবি সেক্রেটারি অভিষেক ডালমিয়া। ছবি: সংগৃহীত।
>ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) ১০ সদস্যের কিউরেটর প্যানেলের প্রধান আশিস ভৌমিক। বাড়ি ত্রিপুরার আগরতলায়। বাংলাদেশের সঙ্গেও যোগসূত্র আছে তাঁর। উইকেট বানাতে তাঁর পছন্দ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি!

তিনি ছিলেন আড্ডার মুডে। আড্ডার কথা, শরীরী ভঙ্গি খুব পরিচিত। যেন ভদ্রলোকের সঙ্গে এইমাত্র পরিচয় হয়নি। অনেক দিনের চেনা।

ভদ্রলোকের নাম আশিস ভৌমিক। আড্ডাটা জমে উঠেছিল গত মাসে কলকাতায় বাংলাদেশ-ভারত প্রথম গোলাপি টেস্টের আগের দুপুরে। আড্ডাস্থল ইডেন গার্ডেনের কিউরেটর সুজন মুখার্জির টেন্ট। আশিস ভৌমিকের পরিচয়টাও দিয়ে দেওয়া যাক। বর্তমানে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) ১০ সদস্যের কিউরেটর প্যানেলের প্রধান। বাড়ি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়।

বহুল আলোচিত গোলাপি টেস্ট মাঠে গড়াবে পরদিন। স্বয়ং বিসিসিআইর প্রধান কিউরেটরকে হাতের কাছে পেয়ে কৌতূহল দমিয়ে রাখা গেল না।

—গোলাপি টেস্টের উইকেট নিয়ে তো অনেক আলোচনা। আপনার কী মনে হয়, উইকেট কেমন হতে পারে?
আশিস ভৌমিক: (একগাল হেসে) ওসব নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। আমার কথা বলার সুযোগ নেই। কিছু জানতে চাইলে এখানকার কিউরেটরকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
পাশেই বসা ইডেনের কিউরেটর সুজন মুখার্জির কড়মড়ে দৃষ্টি দেখে এ নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে গেল। কিন্তু ভারতের প্রধান কিউরেটরকে হাতে পেয়ে তো এভাবে ছেড়ে দেওয়া চলে না! দেশটির স্পিনস্বর্গ উইকেটগুলো পেসসহায়ক স্পোর্টিং উইকেট হয়ে ওঠার জমানায় এমন সুযোগ ছাড়া মানে লোপ্পা ক্যাচ ফেলে দেওয়া। ইন্দোর টেস্টে ভারতের ত্রিশূল পেস আক্রমণের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ত্রাহি অবস্থার পর তখন বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তাদের গলায়ও পেসসহায়ক উইকেটের তৃষ্ণা।
কিন্তু কীভাবে এগোনো যায়? আশিস ভৌমিক আগরতলার মানুষ, কথা বলেন বাংলায়, সেটি আবার কুমিল্লার টানে। আগরতলার সঙ্গে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক দুইভাবেই যোগসূত্র আছে কুমিল্লার। আলোচনা এগিয়ে গেল সেদিকে।

—আগরতলা তো কুমিল্লার পাশেই। কুমিল্লার অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন আছেন আগরতলায়। আপনাদেরও যাওয়া-আসা আছে নিশ্চয়ই...
আশিস ভৌমিক: ছোটবেলায় তো স্কুল ছুটি মানেই ছিল কুমিল্লায় বেড়ানো। ১৯৭১ সালের পর কিছুদিন পাসপোর্টও লাগত না যেতে। আমার মামাবাড়ি ওখানে। কুমিল্লার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান মাতৃভান্ডার আমার মামাদের। শংকর সেন গুপ্ত আমার মার মাসতুতো ভাই। কুমিল্লায় অনেক বছর হলো যাওয়া হয় না। তবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

শংকর সেন গুপ্ত মারা গেছেন বছর দুয়েক হলো। মুঠোফোনে গতকাল কথা হচ্ছিল তাঁর মেয়ে ডা. সুস্মিতা সেন গুপ্তার সঙ্গে। বাপিদার (পরিবারে এ নামেই পরিচিত আশিস ভৌমিক) কথা বলতেই কণ্ঠে চাঞ্চল্য, ‘উনি আমার বড় ভাই। একসময় তাঁরা নিয়মিত আসতেন আমাদের বাসায়।’ শুধু কুমিল্লা শহর নয়, ঢাকার বুড়িগঙ্গাতীরেও শৈশবে পা পড়েছে আশিসের। পূর্বপুরুষের কাঁচামালের ব্যবসা ছিল সেখানে। বড় হয়ে শৌখিন ফটোসাংবাদিক হিসেবে আগরতলা প্রেসক্লাবের হয়ে প্রীতি ক্রিকেট খেলতেও ঘুরে গেছেন ঢাকায়।

তা রক্তের টান আর ভাষার টান একসঙ্গে মিলে গেলে কি মাটির টানটাও এসে পড়ে? হয়তো আসে। নইলে বিসিসিআইর প্রধান কিউরেটরের কেন উইকেট বানাতে পছন্দ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি!
১৯৯৭ সালের এপ্রিলে বিসিসিআইয়ের উদ্যোগে কিউরেটরদের প্রথম সেমিনার হলো কলকাতায়। সেমিনার থেকে ফিরে বিনা বেতনে ত্রিপুরার কিউরেটরের দায়িত্ব নেন আশিস। উইকেট বানানোর জন্য তখন থেকেই পছন্দ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি, ‘আগরতলার উইকেটে কিন্তু বেশ পেস-বাউন্স আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে অংশটা আগরতলার দিকে, আমি সেখান থেকে মাটি এনে উইকেট বানাতাম।’

২০১২ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলের কিউরেটর হয়ে আশিস এখন বিসিসিআইর প্রধান কিউরেটর। বোর্ডের কিউরেটর নিয়োগ পরীক্ষায় পড়ানো হয় তাঁর লেখা ম্যানুয়েল। অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে উইকেট আর মাটির রসায়নটাও তিনি আরও ভালো বুঝেছেন, ‘বিশ্বে মোট চার ধরনের মাটি উইকেট বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। ভারতের সুবিধা হলো এখানে এই চার ধরনের মাটিই পাওয়া যায়।’

২০১২ সাল থেকে ভারত যে আস্তে আস্তে স্পোর্টিং উইকেটের দিকে ঝুঁকতে লাগল, সেটির বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে এ কারণেই। ভারতের সাবেক প্রধান কিউরেটর দলজিৎ সিংকে ‘গুরু’ মানেন আশিস ভৌমিক। বিসিসিআইয়ের সিদ্ধান্ত, ‘গুরু’র প্রেরণা আর পেস বোলার হিসেবে নিজের কিঞ্চিৎ খেলার অভিজ্ঞতা মিলে আশিসের উপলব্ধিতেও খুব ভালোভাবে গেঁথে গেছে স্পোর্টিং উইকেট, ‘টুকটাক যা-ই খেলেছি, দেখেছি ৫-৬ ওভার পর এখানে পেসারদের দরকার পড়ে না। ২০১২ সালে দলজিৎ সিং যখন মোহালিতে পেসসহায়ক উইকেট বানানোর কথা বললেন, আমারও মনে হলো এর বিকল্প নেই। ভারতে পেস উইকেট বানানোর যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। আমাকে সে যুদ্ধের একজন যোদ্ধা বলতে পারেন।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন ‘যুদ্ধে’র ঘোষণা প্রতিবছর শোনা যায়। কিন্তু দামামাই সার, ‘যুদ্ধ’ আর বাধে না। এখানে যে নেই দলজিৎ সিংয়ের মতো একজন ‘সেনাপতি’, নেই আশিস ভৌমিকের মতো ‘যোদ্ধা’ও! দলজিৎ সিংয়ের ভূমিকায় আছেন একজন শ্রীলঙ্কান। স্থানীয় সহকর্মীদের সঙ্গে আছেন দুই ভারতীয় কিউরেটরও।
আশিসের বিশ্বাস, বাংলাদেশেও ভালো উইকেট বানানো সম্ভব। কিন্তু সেটি বানানোর মূল দায়িত্ব যাঁদের, ভাষার টান আর মাটির টানটাই যে নেই তাঁদের মধ্যে!