‘বিপিএল কাপ’ নাকি ‘প্রবলেম লিগ’
বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একবার গাইতে এলেন কলকাতার বিখ্যাত এক শিল্পী। মঞ্চ কাঁপিয়ে তিনি গাইলেন, ‘বিপিএল কাপ… বিপিএল কাপ।’ গানের বাকি কথাগুলো এখন আর মনে নেই। মনে থাকার দরকারও নেই। ওই গানের দুটি শব্দই বিখ্যাত হয়েছে—বিপিএল কাপ।
বিপিএল মানে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। এর সঙ্গে ‘কাপ’ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত একটা ধাক্কা দিতে, শুধু বিপিএল বললে যেটা আসে না। ‘বিপিএল কাপ’ বললে ‘বাপরে বাপ’ জাতীয় একটা ধাক্কা লাগে। পুরো গানে কলকাতার সেই শিল্পী বেশ ভালোভাবে ধাক্কাটা দিয়ে গেলেন।
তো সেই ‘বিপিএল কাপ’ আবারও সমাগত এবং এরই মধ্যে কিঞ্চিৎ ধাক্কাধাক্কিও শুরু হয়ে গেছে। এই যেমন ঢাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে যা হলো। আজ বিপিএলের প্লেয়ার্স ড্রাফট। অথচ আগেই ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও গতকাল জানানো হলো তাদের মালিকানা বাতিল! মালিকপক্ষ নাকি যথাসময়ে অংশগ্রহণ ফি দিতে পারেনি।
এ নিয়ে ফেসবুক বেশ সরগরম। কিন্তু আমি বলি এটা তো বরং পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষণ!
এমনও তো হতে পারত অংশগ্রহণ ফি ছাড়াই বিসিবি তাদের ঢাকার মালিকানা দিয়ে দিল। পরে বিপিএলের মাঝপথে গুমর ফাঁস হলো। অথবা দলটা কাগজীয় শর্ত পূরণ না করেই খেলায় জিতে-টিতে সেমিফাইনালে উঠে গেল। কিন্তু সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষে প্রভাবশালী কেউ থাকল। ব্যস, ম্যাচের আগের রাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসে মেঁও মেঁও শুরু করতে লাগল—আরে, এদের তো অংশগ্রহণ ফি–ই দেওয়া নেই! হটাও ওদের সেমিফাইনাল থেকে!
বিপিএলে টাকা-পয়সার লেনদেন বরাবরই আলোচনার জন্ম দিয়ে আসছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট মানেই অর্থের ঝনঝনানি। বিপিএলেও তা–ই, তবে এখানে ঝনঝনানিটা নেতিবাচক আলোচনা থেকেই বেশি আসে।
ব্যাংক গ্যারান্টির কথাই ধরুন। এই একটা ব্যাপার তো বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের কর্মকাণ্ডে প্রায়শই মরীচিকা হয়ে দেখা দেয়। এই আছে, এই নেই। একবার এক প্রতিষ্ঠান বিপিএলের সম্প্রচারস্বত্ব পেল। নিয়ম অনুযায়ী তারা বিসিবিকে ব্যাংক গ্যারান্টি দিল।
পরে যখন ওই প্রতিষ্ঠান টাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করল, কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, তাদের ব্যাংক গ্যারান্টির চেকটা বিসিবির ড্রয়ারে নেই! চারদিকে কোথায় গেল, কোথায় গেল রব। পরে জানা গেল, তৎকালীন বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল কী এক ‘আত্মীয়তার আবেগে’ সবার অলক্ষ্যে সেই চেক প্রতিষ্ঠানটিকে ফেরত দিয়ে দিয়েছেন!
এবার তো ‘ডাবল বিতর্ক’ দিয়েই শুরু হচ্ছে বিপিএল। ঢাকার ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা তো বলাই হলো, ঝামেলা হয়েছে ড্রাফটের খেলোয়াড় তালিকা নিয়েও। আজ দুপুরে প্লেয়ার্স ড্রাফট, অথচ ড্রাফটের জন্য খেলোয়াড় তালিকা প্রকাশ করা হয়নি কাল রাত পর্যন্তও! সেটি প্রকাশ হয়েছে আজ সকালে।
কাজেই এই বিপিএলও যে ‘ধারাবাহিকতা’ অক্ষুণ্ন রেখে আরও অনেক নাটক দেখাবে, সেটা গ্যারান্টি দিয়েই অনুমান করা যাচ্ছে।
আসলে বিপিএলে কখনোই শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাদের কিছু না কিছু বাকি থেকেই যায়, যেটা পরে সুযোগ এবং পরিস্থিতি বুঝে বলা হয়, করা হয়। এ কারণে বিপিএলকে চাইলে ‘বাকি প্রিমিয়ার লিগ’ও বলতে পারেন।
‘বাকি’ আর ‘বকেয়া’ সমার্থক শব্দ। শুরুতে অনেকের কাছে যেমন বিপিএল নাম পেয়ে গিয়েছিল ‘বকেয়া প্রিমিয়ার লিগ।’ বিসিবি ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি পায় না, সেটা জমা হয় বাকির খাতায়। দেশি খেলোয়াড়েরা বিসিবিতে বিচার নিয়ে আসেন, ‘আমাদের টাকা তো ফ্র্যাঞ্চাইজিরা বকেয়া রেখে দিয়েছে!’ বিদেশি খেলোয়াড়েরা সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের টাকাও বকেয়া।’ টুর্নামেন্ট শেষে জানা যায়, বিসিবির ৫০০ টাকা দৈনিক ভাতায় নিয়োজিত কর্মচারীদের টাকাও নাকি বাকি পড়ে আছে! এভাবেই চলছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। নাকি ‘বাংলাদেশ প্রবলেম লিগ?’
বিপিএলের প্রথম আসর মাঠে গড়ায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এবং শুরু থেকেই এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে ‘প্রবলেম’ আর ‘প্রবলেম’। ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে ‘প্রবলেম’, ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক নিয়ে ‘প্রবলেম’, টুর্নামেন্টের বাইলজ নিয়ে ‘প্রবলেম’, খেলোয়াড় নিয়ে ‘প্রবলেম।’ সঙ্গে টাকা-পয়সার ‘প্রবলেম’ তো আছেই।
বিপিএলে ‘প্রবলেম’ তৈরির চেষ্টা হয়েছে দেশের বাইরে থেকেও। আইসিসির সাবেক এক প্রধান একবার তাঁর দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের বাজার কমে যাওয়ার শঙ্কায় বিসিবিকে বিপিএল বন্ধের চাপ দিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, সাবেক বিসিবি সভাপতি ও বর্তমানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছ থেকে উল্টো কড়া জবাব পেয়েছিলেন তিনি।
আইপিএলের আদলে বিপিএলের ধারণা মূলত মুস্তফা কামালের ‘ব্রেইন চাইল্ড।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতনের আওতায় আনা, মাঠকর্মীদের দিনমজুর থেকে বিসিবির কর্মী বানানো, বিসিবির এফডিআরের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়া—মুস্তফা কামালের সময়ের এ রকম আরও অনেক কিছুরই সুফল এখনো পাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এরপর এমনকি নতুন কোনো নিয়মিত টুর্নামেন্টও মাঠে নামাতে পারেনি বিসিবি।
বিপিএলটাও চলছে সমস্যা আর বিতর্ক সঙ্গী করে। বিসিবি দাবি করে, বিশ্বের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর মধ্যে আইপিএলের পরেই নাকি বিপিএলের অবস্থান। যদিও বিপিএলের পরে শুরু করা অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও এখন বিপিএলের চেয়ে সবদিক দিয়ে সুগঠিত।
এবারের বিপিএল টুর্নামেন্টটির অষ্টম আসর। অথচ আজ পর্যন্তও বিপিএল পায়নি কোনো মজবুত আর্থিক কাঠামো। ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তি থেকে শুরু করে খেলোয়াড় বেচা-কেনা, টুর্নামেন্টের নিয়ম-কানুন সবকিছুই যেন দায়সারা আর জোড়াতালি দিয়ে চালানো। বিপিএল থেকে বিসিবির আর্থিক লাভ-ক্ষতি নিয়েও কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না।
বিপিএলের দুই হাত ধরে চলে অনিয়ম আর পক্ষপাতমূলক আচরণ। এখানে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা থাকেন দুই ধরনের। বিসিবির কাছের মালিক এবং দূরের মালিক। দূরের মালিকদের জন্য যেটা কঠোর নিয়ম, কাছের মালিকদের জন্য সেটা হয়তো কোনো নিয়মই নয়। ‘পাওয়ার হিটিং’ আর ‘পাওয়ার প্লে’র দেখা বিপিএলে মাঠের বাইরেও বেশ মেলে।
প্রথম বিপিএলের একটা ঘটনা। টুর্নামেন্ট সেমিফাইনাল পর্বে আসার পর বিতর্ক বেঁধে গেল বাইলজ নিয়ে। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে বাইলজে ছিল এক নিয়ম, সেমিফাইনাল পর্বে আসার পর বলা হলো, ‘না, না, নিয়ম এটা নয়। নিয়ম তো আসলে ওটা!’ পরিষ্কারভাবেই সেটা ছিল বিশেষ একটি দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতে।
পরের বিপিএলে হলো স্পট ফিক্সিং কাণ্ড। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই কালো এক অধ্যায় সেটি। তবে দোষীরা শাস্তি পেয়েছেন, এটা ভালো দিক। দৃশ্যত বিপিএল অন্তত এই জায়গায় এখন পর্যন্ত কঠোর থাকতে পেরেছে।
এবারও টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই জুয়াড়িদের কাছ থেকে খেলায় নয়-ছয় করার প্রস্তাব পেয়ে গেছেন এক খেলোয়াড়। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তা জানিয়ে দিয়েছেন বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগকে।
কিন্তু বিপিএল আয়োজন নিয়ে প্রতি আসরেই যে হাস্যকর এবং লজ্জাজনক কাণ্ডগুলো ঘটে, সেগুলো দেখবে কে? ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হিসেবে যত দিন না বিপিএলের একটা নির্দিষ্ট অবয়ব দাঁড়াবে, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ আসলেই হয়ে থাকবে ‘বাংলাদেশ প্রবলেম লিগ।’