‘বাজবল’ শব্দটা পছন্দ হচ্ছে না ম্যাককালামেরই
ইউরোপের ফুটবলে শব্দটার প্রচলন অনেক। মরিসিও সারি চেলসিতে থাকার সময়ে তাঁর পাসিং ফুটবল কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সারি-বল’, বার্সেলোনায় জাভি হার্নান্দেজের কৌশলকে বলা হয় ‘জাভি-বল।’
ক্রিকেটে এমন নাম এর আগে তেমন দেখা যায়নি। সেদিক থেকে ‘বাজবল’ অনন্যই। ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর যুক্তরাজ্য সংস্করণের সম্পাদক অ্যান্ড্রু মিলার এক পডকাস্টে নামটা দিয়েছিলেন। সহজ হিসাব, ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের নতুন কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ডাকনাম ‘বাজ’, সেটির সঙ্গে মিলিয়ে ইংল্যান্ডের আগ্রাসী ক্রিকেটের নাম বানিয়ে দিলেন ‘বাজবল!’ তবে এই বাজবল নামটা নিয়ে এত মাতামাতি ভালো লাগছে না স্বয়ং বাজ-এরই।
অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি অধিনায়ক অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সঞ্চালনায় অস্ট্রেলিয়ান এসইএন রেডিওর ডব্লুএ ব্রেকফাস্ট শো-তে ম্যাককালামের সহজ জবাব, ‘আমি বুঝি না এই ‘বাজবল’ জিনিসটা কী! আপনি যদি ভালো করে খেয়াল করেন তাহলে বুঝবেন, আমাদের কৌশল তো শুধু ধরো-মারো খেলা নয়। সে কারণে মানুষ এই যে হাস্যকর উপাধি দিচ্ছে, এগুলো আমার খুব একটা ভালো লাগে না।’
টেস্ট ক্রিকেট যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য সময়টা একটু চ্যালেঞ্জিং। কারণ সমাজ বদলে গেছে। মানুষের এখন আর পাঁচ দিন বসে ক্রিকেট দেখার সময় নেই।
মিলার নামটা দেওয়ার সময় অবশ্য ইংল্যান্ড ম্যাককালামের অধীনে তখনো খেলেনি। খেলোয়াড়ি জীবনে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক থাকার সময়ে যেভাবে দলটাকে নিজের ছাঁচের আগ্রাসী ক্রিকেটে দারুণ আকর্ষণীয় একটা দল বানিয়েছিলেন ম্যাককালাম, ইংল্যান্ডের টেস্ট দলেও বেন স্টোকসকে অধিনায়ক হিসেবে পেয়ে ম্যাককালাম তেমন কিছুই করবেন, সেই আশাই হয়তো ছিল এমন নামকরণের পেছনের ভাবনা।
তা ম্যাককালামের অধীনে এরপর ইংল্যান্ড যখন খেলেছে, বাজবল নামটাকে আরও জনপ্রিয়তা এনে দেওয়া ক্রিকেটে মুগ্ধই করেছে স্টোকসের অধীন দলটা। চার টেস্টের চারটিই জিতেছে, চারটিতেই শেষ ইনিংসে দারুণ আগ্রাসী ক্রিকেটে রান তাড়া করেছে। নিউজিল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করার পথে তিন টেস্টে ২৭০-এর বেশি তাড়া করেছে, ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে তো ৩৭৮ রান তাড়া করে জেতার পথে ইংল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়ার রেকর্ডই নতুন করে লিখেছে।
কিন্তু এমন দারুণ পারফরম্যান্সকে বাজবল নাম দিয়ে শুধু ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট বোঝানোই পছন্দ হচ্ছে না ম্যাককালামের। ‘কারণ এখানে ছেলেরা কীভাবে খেলবে, কেমন খেলবে সেটার পেছনে অনেক চিন্তা ভাবনা থাকে। কখন প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চাপ বাড়াবে, কোন বোলারের ওপর চড়াও হবে… এমন অনেক মুহূর্তও ছিল যখন ওরা (ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান-বোলাররা) দারুণভাবে চাপ সয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে’—ম্যাককালামের ব্যাখ্যা।
তবে নাম নিয়ে ম্যাককালামের আপত্তি যতই থাকুক, তাঁর অধীনে ইংল্যান্ডের এই কৌশল যে টেস্ট ক্রিকেটকেই বদলে দেবে, সে নিয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই সংশয় নেই। গিলক্রিস্টও এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন ম্যাককালামকে। তাতে ইংল্যান্ডের টেস্ট কোচের উত্তর, ‘আমি কখনোই সেটা বলব না। আমরা শুধু একটাই চেষ্টা করি, সেটা হলো, এমন একটা ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলানো যেটা ছেলেদের সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেবে, ওদের জয়ের সবচেয়ে সেরা সুযোগ তৈরি করে দেবে। তা ছাড়া মানুষকে বিনোদন দেওয়ার দায়িত্বও তো আছে।’
ম্যাককালামের ক্রিকেট মানে তো তা-ই। খেলোয়াড়ি জীবনে ব্যাট হাতে চার-ছক্কায় কিংবা উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে ক্ষিপ্রতায় যেমন ছিল, এখন কোচ হিসেবেও দর্শনটা বদলানোর কোনো কারণ নেই। বিনোদনই ম্যাককালামের ক্রিকেট–দর্শনের সঞ্জীবনী।
কেন? ম্যাককালামের ব্যাখ্যা, ‘টেস্ট ক্রিকেট যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য সময়টা একটু চ্যালেঞ্জিং। কারণ সমাজ বদলে গেছে। মানুষের এখন আর পাঁচ দিন বসে ক্রিকেট দেখার সময় নেই। সে কারণে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে আমাদের হাতে যে পণ্যটা (বিনোদনের উৎস) আছে, মানুষের দুয়ারে আমরা যে পণ্যটা পৌঁছে দিচ্ছি, সেটি যেন মানুষের সময়টাকে আনন্দময় করে তোলে, তাঁদের কল্পনার রাজ্যে টোকা দেয়।’
অবশ্য বিনোদনদায়ী এ ধরনের ক্রিকেট ইংল্যান্ডের এই দলের সঙ্গে যায় বলেই রায় ম্যাককালামের, ‘কোচ হিসেবে আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে এই ধরণটা আমার সঙ্গে যায়, কারণ আমি ক্রিকেটটা এভাবেই খেলতে দেখতে পছন্দ করি। একই কথা আমাদের অধিনায়কের (স্টোকস) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’
তাঁর অধীনে ইংল্যান্ড দলের মনোভাবে, ক্রিকেটের ধরনে বদলের পাশাপাশি আরেকটি বদলের কথাও জানিয়েছেন ম্যাককালাম, যেটি ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমে স্থিরতা এনেছে, স্বস্তি দিয়েছে। কী? সব সময়ই একটু বেশি উত্তেজিত ইংলিশ সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে থাকা। ‘এখানকার সংবাদমাধ্যমের প্রভাব অনেক বিশাল। সে কারণে ইতিবাচক, নেতিবাচক যা কিছুই হোক, সেটি ড্রেসিংরুমের পরিবেশে প্রভাব ফেলে। আমরা যা করেছি তা হলো একে অন্যের সঙ্গে পুরোপুরি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি, বাইরের ব্যাপারগুলো ড্রেসিংরুমের ভেতরে আসতে দিইনি, বাইরের জগতের (সংবাদমাধ্যম ও সমর্থকদের) মাতামাতির আওয়াজ কিছুটা কমিয়ে এনেছি। আমার মনে হয় সেটা ভালোই কাজে দিয়েছে’—ম্যাককালামের ব্যাখ্যা।