বাংলাদেশকে এ দিন টেস্ট খেলা শিখিয়েছিলেন গিলেস্পি
‘পড়ে না উইকেট যখন আর কিছুতেই/ বিরামহীন বল করায় মন বসে না/ খাটুনির ধকলে মাথা কুটে মরে/দেখি নৈশপ্রহরীর মশালে ডাবলের ছটা!’
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের চরণগুলোর ক্রিকেটীয় সংস্করণ। সেদিন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে এমন বেকায়দায়ই পড়েছিল বাংলাদেশ।
মাইক হাসির সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৩২০ রানের জুটি গড়লেন কি না, ‘এক নাইটওয়াচম্যান’! সেই ‘নৈশপ্রহরী’ ইতিহাস গড়া ইনিংস খেলার সময়ই টের পেয়েছিলেন, জাতীয় দলে আর হয়তো ফুটবে না দিনের আলো।
জায়গাটা চট্টগ্রাম,আর সালটা ২০০৬ বললেই সব বুঝে ফেলার কথা। টেস্ট ক্রিকেটে ১৪৩ বছরের পথচলায় ডাবল সেঞ্চুরি আছে তিন শ-র বেশি। জেসন গিলেস্পি, সেই দিন থেকে একটি জায়গায় আজও আলাদা—তাঁর মতো নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে টেস্টে আর কেউ ডাবল সেঞ্চুরি পায়নি।
প্রতিপক্ষ ছিল কোন দল তা না বললেও চলে। তিন বছর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাশরাফি বিন মুর্তজা একবার বলেছিলেন, ‘খুবই দুঃখজনক স্মৃতি। অস্বস্তিকরও। ওকে আউট করার সব রকম চেষ্টাই করেছিলাম। সুযোগও দিয়েছিল। কিন্তু ওটা ওর ভাগ্যে ছিল। গিলেস্পির ওই ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে জীবনে অনেক খোঁচা শুনতে হয়েছে। পত্রপত্রিকায় কম লেখা হয়েছে নাকি! নাইটওয়াচম্যান নেমে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলে, এটা কেমন বোলিং...আরও কত-কী!’
মাশরাফির মতে, ওটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা দল। শুধু গ্লেন ম্যাকগ্রাই ছিলেন না। এমন একটা দলে সেদিন গিলেস্পি ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন তিনে। দিনের খেলা শেষ হওয়ার কিছু বাকি এমন সময় নাইটওয়াচম্যান পাঠানোর নজির খুব বেশি নেই অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু ম্যাথু হেইডেন আউট হলে ব্যাটিং অর্ডারে লেজ থেকে গিলেস্পিকে পাঠান অধিনায়ক রিকি পন্টিং। বাকিটা ইতিহাস।
বাংলাদেশের জন্য সে ইতিহাসের পরতে পরতে ফিল্ডিং-বোলিং করতে করতে হাত লম্বা হওয়ার দুঃখগাথা। কিন্তু গিলেস্পির জন্য সেটি ছিল ৩১তম জন্মদিনে নিজেকে দেওয়া সেরা উপহার। সংখ্যাগুলো একবার পড়ুন, ৫৭৪ মিনিট উইকেটে থেকে ৪২৫ বল খেলে ২টি ছক্কা আর ২৬টি চারে অপরাজিত ২০১। ভাবা যায়! এমন নয় যে উইকেট একদম পাটা ছিল। বল এদিক-সেদিক করছিল বলেই স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের দিনের শেষ আলোয় অযথা বিপদে না ফেলতে গিলেস্পিকে ঠেলে দিয়েছিলেন পন্টিং। গিলেস্পি নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ?
টেস্টে অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানের ডাবল সেঞ্চুরি নেই। রিচি রিচার্ডসন, ডেসমন্ড হেইন্স, মাইক হাসি, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, মার্ক ওয়াহ, দিলীপ ভেংসরকারদের এই অপূণর্তা আছে যা নেই গিলেস্পির। দল ইনিংস ঘোষণা করায় গিলেস্পি আর এগোতে পারেননি। নইলে সেদিন তাঁর ওপর কী ভর করেছিল, ঠেকতেন কোন চূড়ায় উঠে, তা কে জানে!
যতটুকুতে থামতে হয়েছে, তা সতীর্থদের পিত্তি জ্বালিয়ে দিতে পর্যাপ্ত। গিলেস্পির সঙ্গে সেদিন জুটি বেঁধে তিন শ রানের বেশি তোলা হাসি আউট হয়েছিলেন ১৮২ করে। পরে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘দ্য রোরে’-এ নিজের ইনিংস নিয়ে লেখায় বেশ রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন গিলেস্পি। ‘মি: ক্রিকেট'খ্যাত হাসির ইনিংস সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘হাসিকে দেখে রাখতে হয়েছিল। কারণ কঠিন সময়ে (বেশির ভাগ সময়ই এমন ছিল) সে বাজে শট খেলছিল, সিঙ্গেলসগুলো ছিল আত্মঘাতী। আমি ঠান্ডা মাথায় আগলে রাখার জন্যই সে ১৮০-র মতো করতে পারে। পরে চাপ নিতে পারেনি। আউট হয়ে যায়।’
সতীর্থ মার্ক ওয়াহকেও ছাড়েননি গিলেস্পি। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে অন্যতম স্টাইলিশ এ ব্যাটসম্যানের টেস্টে সর্বোচ্চ স্কোর ১৫৩। গিলেস্পি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, টেস্টে ১৬০ রানের ওপাশে ব্যাটিং করা শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জিং? এরপর নিজেই ফোড়ন কেটেছিলেন, ‘ওহ, দুঃখিত। এটা তোমার জানার কথা না।’
টের পেয়েছিল বাংলাদেশের বোলাররা। টেস্টে সেসব দিন বিচারে মাশরাফি-শাহাদত, রফিক-রাজ্জাক জুটি খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু সেদিন চোস্ত ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠা গিলেস্পির কাছে নাকাল হয়েছিলেন সবাই। অনেকে মজা করে বলেন, বাংলাদেশের বোলারদের অভিশাপেই গিলেস্পির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল!
নিজের সেই ইনিংসের আগের পরিস্থিতি নিয়ে গিলেস্পি তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘তিনে আমাদের বিখ্যাত রিকি পন্টিং এসে বলল প্যাড পরতে। তাঁর মনে হয়েছে, বাংলাদেশের এই আক্রমণভাগ যথেষ্ট বিপজ্জনক। তার কাজটা আমি করে দিতে পারব কি না? ভাবলাম আলো কমে আসছে, সিমাররা মুভমেন্ট পাচ্ছে বাতাসে, আর উইকেটের বাউন্স অসমান প্রথম দিনেই। এই উইকেট দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের জন্য নয়।’
প্রথম দিন শেষে ৫ রানে অপরাজিত ছিলেন গিলেস্পি। পরদিন বৃষ্টি হানা দেওয়ায় খেলা হয়েছিল মাত্র ২২ ওভার। গিলেস্পি অপরাজিত ছিলেন ২৮ রানে। তৃতীয় তিনে পেয়ে যান পঞ্চম নাইটওয়াচম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির দেখা। চতুর্থ দিন মোহাম্মদ রফিককে বাউন্ডারি মেরে গিলেস্পি পেয়ে যান অমরত্বের দেখা। ডাবল সেঞ্চুরি!
‘বাংলাদেশের বোলারদের কাছে কোনো জবাব ছিল না। ওরা আমাকে কভার ড্রাইভ খেলিয়েছে। অমন আর্দ্রতার মধ্যে দৌড়ে রান নিতে কোনো সমস্যা হয়নি। রফিককে চার মেরে ২০১ পেয়ে যাওয়ার পর গোটা স্টেডিয়াম ফেটে পড়ল। ড্রেসিং রুমের বারান্দায় সতীর্থদের অবিশ্বাস্য চাহনি—বুঝি না কেন বার বার এমন হয়। মাইকেল ক্লার্ক ছিল অপর প্রান্তে। বেরিয়ে আসার (ইনিংস ঘোষণা) সময় তরুণ ছোকরাটিকে জড়িয়ে ধরে এক চিলতে পরামর্শ দিলাম, খোকা, ডাবল সেঞ্চুরি এভাবেই করতে হয়!’
গিলেস্পির ‘সুদূরতম কল্পনাতে’ সেঞ্চুরিও ছিল না। সেখানে কি না ডাবল! অস্ট্রেলিয়া সে টেস্ট ইনিংস ও ৮০ রানে জেতার পর ড্রেসিং রুমে গিলেস্পিকে বিজয়ের গান ধরতে অনুরোধ করেছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অথচ কাজটা ছিল গিলির। গিলেস্পি সেদিনই বুঝে যান, ক্যারিয়ারের অন্য সূর্যটার দেখা পেলেন তিনি শেষ বিন্দুতে পৌঁছে।
বাংলাদেশে আসার আগে গিলেস্পির পারফরম্যান্স মোটেও ভালো ছিল না। অ্যাশেজে বাজে করেছিলেন, ভালো হয়নি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ। বাংলাদেশ সফর শেষে আর জাতীয় দলে ডাক মেলেনি গিলেস্পির। এর পর ৩২তম জন্মদিনেও ইয়র্কশায়ারের হয়ে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আগের জন্মদিনের রংই সবচেয়ে বেশি। জন্মদিনে ডাবল সেঞ্চুরি, সেটিও টেস্ট ইতিহাসে প্রথম নাইটওয়াচম্যান হিসেবে(!)- টিকে আছে আজও।
টিকে আছে ব্যথাও। দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলার যন্ত্রণা। সেই ইনিংস নিয়ে গিলেস্পি আর বাংলাদেশ অন্তত এই একটি জায়গায় একসূত্রে গাঁথা, একপক্ষের বুকে ডাবল সেঞ্চুরি করে বাদ পড়ার ব্যথা, অন্য পক্ষের বুকে সেই ডাবল ভুলতে না পারার যন্ত্রণা।
আর এই সবকিছু ঘটেছিল ১৪ বছর আগে এই দিনে! তাও আবার নিজের জন্মদিনে!
৪৫ তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা, জেসন গিলেস্পি!