বাংলাদেশ স্পিনে খারাপ না, বাংলাদেশ স্পিনে ভালো না!
বাংলাদেশ দলের মতো বিভ্রম জাগাতে পারে খুব কম দল।
উপমহাদেশের বাইরে বরাবরই বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ পেসারদের মুখোমুখি হওয়া। বাড়তি বাউন্স আর গতিতে টালমাটাল হয় ব্যাটসম্যানরা। তাই ভাবনা থাকে পেসারদের নিয়ে। আর এবার মুদ্রার অন্য পিঠ দেখল বাংলাদেশ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় যেকোনো সফরকারী দল ভোগে পেসারদের সামনে। ওদিকে বাংলাদেশ দল যদি কোনো ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষে একটু হলেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেটা স্পিন। সেই স্পিনারদের সামনে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশ, এমনটা কে ভেবেছিল?
টানা দুই টেস্টে প্রতিপক্ষের মাঠে দ্বিতীয় ইনিংসে কোনো পেস বোলারকে বল হাতে নিতে হয়নি, এমন কিছু দেখতে হবে কে ভেবেছিল! এই সিরিজের আগে, সম্ভবত কেউ নয়।
পোর্ট এলিজাবেথ টেস্ট শেষ হওয়ার পর একটি প্রশ্ন সামনে আসছে, পেস তো পেস, ভালো স্পিনারদের সামলাতে পারে তো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা!
ডারবান টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার কেশব মহারাজ ও সাইমন হারমারের সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন মুমিনুল-মুশফিকরা। মাত্র ১৯ ওভার টিকে টেস্টে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ৫৩ রান করেছিল বাংলাদেশ। পঞ্চম দিনে টেস্ট ড্র বা জেতার স্বপ্ন নিয়ে নেমে মাত্র ৫৫ মিনিটে শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস।
কালও ব্যাটিংয়ের রুগ্ণ স্বাস্থ্য বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশের। এবার চতুর্থ ইনিংসে সাড়ে ৪ ওভার বেশি খেলতে পেরেছে দল, রানও বেশি পেয়েছে ২৭টি। সেই মহারাজ আর হারমারের স্পিন ভেলকিতে আবার অসহায় আত্মসমর্পণ ব্যাটসম্যানদের। এবার দুই দিন টিকে থাকার লড়াইয়ে নামা দল চতুর্থ দিনে ৫৯ মিনিটের মধ্যে খুইয়েছে ৭ উইকেট।
বিভ্রম যে বাংলাদেশ দল শুধু খেলাতেই জাগায় এমন নয়। কথা দিয়ে বিস্ময় জাগাচ্ছেন দলের কোচ-অধিনায়কও। ডারবান টেস্ট শেষে অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেছিলেন, বিদেশের মাটিতে এসে স্পিনারদের উইকেট দেওয়াটা অনেক বড় ‘ক্রাইম’।
অধিনায়কের কাছে বিষয়টি অপরাধ, কারণ দেশের মাটিতে উইকেট সব সময় স্পিন সহায়ক। স্পিনটা বাংলাদেশের ভালো খেলার কথা। এ কারণে বিদেশে স্পিনের কাছে পরাজিত হওয়া অপরাধ।
কিন্তু কোচ রাসেল ডমিঙ্গো কী বলেছেন? ডারবান টেস্টের পর তিনি বলেছিলেন, ‘একটা ম্যাচ বাজে করলেই সে ব্যাটসম্যান স্পিনের বিপক্ষে খারাপ হয়ে যায় না।’ ডারবানের প্রথম ইনিংসের ইতিবাচক দিকগুলোই নিতে হবে, দ্বিতীয় ইনিংসের ভুলগুলো সংশোধন করতে হবে—এ কথা বলে তাকিয়ে ছিলেন সামনের দিকেও।
খেলতে নামলে একদিন আসলেই এমন কিছু হতে পারে। ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া সফর করতে গিয়ে অ্যাডিলেডে ৩৬ রানে অলআউট হয়েছিল ভারত। কিন্তু সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে দলই অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজে জিতেছিল। কিন্তু ভুল সংশোধন কি করতে পেরেছে বাংলাদেশ? ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন মহারাজ। প্রথম বোলার হিসেবে টানা দুই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে পেয়েছেন ৭ উইকেট। ওদিকে ৪১৩ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে মাত্র ৮০ রান তুলতেই অলআউট ডমিঙ্গোর দল।
এরপরই বিভ্রম জাগালেন মুমিনুল। কাল সংবাদ সম্মেলন করতে এসে রীতিমতো অবাক করে দিলেন, ‘এটা আগে থেকে সবাই জানে। আমরা স্পিনে খুব বেশি ভালো খেলি না। এটা শুনতে হয়তো খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু দু-একজন ছাড়া আমরা খুব ভালো স্পিন খেলি না।’
উপমহাদেশের এক দল, যারা ২২ বছর ধরে টেস্ট খেলছে, যারা ঘরের মাঠের অধিকাংশ সাফল্য পেয়েছে স্পিনে ভর করে, সে দলের অধিনায়ক বলছেন, তাঁরা স্পিনও ভালো খেলেন না!
স্পিন বা পেস বোলিং ভালো খেলার ব্যাপারটা যেমন দক্ষতার, তেমনি নিজের ক্ষমতার প্রয়োগেরও। দুই টেস্টেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দ্বিতীয় দিকটার ঘাটতি দেখা গেছে। তৃতীয় দিনে মহারাজ ও হারমারের বলে মাহমুদুল হাসান, নাজমুল হোসেন ও তামিম ইকবালের আউটে বাড়তি স্পিন ও পড়ে আসা আলোর ভূমিকা ছিল। কিন্তু চতুর্থ দিনে স্পিন খেলতে পারা বা না পারা কোনো ভূমিকা রেখেছে—এ দাবি করা যায় না।
৩ উইকেটে ২৭ রান নিয়ে চতুর্থ দিন শুরু করে বাংলাদেশ। টেস্ট বাঁচাতে তখন ব্যাটসম্যানদের প্রয়োজন ছিল উইকেটে পড়ে থাকা। ধৈর্য আর বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা যেন একজন অন্যজনের থেকে বেশি অধৈর্য। একের পর এক আত্মঘাতী শটে উইকেট উপহার দেন মহারাজ আর হারমারকে।
নিজের প্রথম ওভারেই মুশফিককে ফেরান মহারাজ। প্রথম ইনিংসে রিভার্স সুইপে আউট হয়ে আলোচনার জন্ম দেওয়া মুশফিক এবার ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন ডিন এলগারের হাতে।
মহারাজের পরের ওভারেই দলকে বিপদে ফেলে প্যাভিলিয়নমুখী মুমিনুল। দলের ভয়ঙ্কর বিপদের মুহূর্তে সুইপ করতে গেলেন। বল তাঁর ব্যাটের কানায় লেগে আকাশে উঠে গেল, মাটিতে আর নামেনি, সহজ ক্যাচ লুফে নেন রিকেলটন। স্পিনে উইকেট দেওয়ার ‘অপরাধে’ও যেন নেতৃত্বটা নিজের কাঁধে নিয়েছেন। টেস্টে সর্বশেষ চার ইনিংসের (৫, ৬, ২, ০) তিনবারই যে স্পিনের কাছে পরাজিত মুমিনুল।
পরের ওভারে হারমারের বলে স্লগ সুইপে আত্মহত্যা ইয়াসির আলীর। পরাজয় নিশ্চিত তখন। ব্যবধান কমাতে কিছুটা লড়ার চেষ্টা করেন লিটন দাস। আক্রমণই সেরা রক্ষণ—এই মন্ত্র মেনে মহারাজকে দুই চার মারেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ২৭ রানে সেই মহারাজের বলে চড়াও হতে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, আর ফেরা হয়নি ক্রিজে।
এরপর তো বাংলাদেশ ইনিংসের লেজই বেরিয়ে পড়ল। মিরাজ ও খালেদকে আউট করে হিউ টেফিল্ডের পরে দ্বিতীয় দক্ষিণ আফ্রিকান স্পিনার হিসেবে টেস্টে দেড় শ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মহারাজ। আর তাইজুলকে আউট করে হারমার আবারও বুঝিয়ে দিলেন এই বাংলাদেশের ইনিংস থামাতে দুই স্পিনারই যথেষ্ট।
সংবাদ সম্মেলনে মুমিনুল দলের স্পিন খেলার ক্ষমতা নিয়ে আরও বলেছেন, ‘(স্পিন) ভালো খেলে হয়তো। কিন্তু কোন দিক দিয়ে খেলতে হবে, সেটা হয়তো আমরা বুঝি না।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সম্ভাব্য ৪০ উইকেটের ২৯ উইকেটই স্পিনারদের কাছে খোয়ানোর পরও বাংলাদেশ স্পিন ভালো খেলে কি খেলে না, সে প্রশ্নের তাই উত্তর পাওয়া গেল না।