বাংলাদেশের অলিম্পিক 'বিশ্ব রেকর্ড'টা যেন না থাকে!
অলিম্পিকে বাংলাদেশের যে একটা রেকর্ড আছে, জানেন কি? না জেনে থাকলে লজ্জিত বা বিব্রত হবেন না। বরং জানা না-থাকাই ভালো। রেকর্ডটাই বিব্রত হওয়ার, লজ্জার। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যাদের একটিও অলিম্পিক পদক নেই। এত জনসংখ্যা নিয়েও পদক নেই—এই বিচিত্র তথ্যের কারণেই প্রতিবার অলিম্পিক হলে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের নামকরা পত্রপত্রিকাগুলো এ নিয়ে বিশেষ ফিচার লেখে। তাদের কাছে তথ্যটা বিচিত্র হলেও বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। এই লজ্জা ঘুচিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো আজ রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে।
এখন পর্যন্ত অলিম্পিকে ১৪৫টি দেশ পদক জিতেছে। এর মধ্যে আছে লিকটেনস্টেইনের মতো দেশও। আয়তন ১৬০ বর্গকিলোমিটার, আয়তনে যা ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক। জনসংখ্যা ৩৮ হাজার। ২টি করে সোনা ও রুপা, ৬টি ব্রোঞ্জ। অলিম্পিকে ১০টি পদক জেতার কীর্তি আছে ইউরোপের এই মানচিত্রে চোখেই পড়ে না এমন দেশটিরও!
অলিম্পিকে অন্তত একটি পদক আছে, জনসংখ্যায় এমন ছোট দেশের সংখ্যা কম নয়। সামোয়ার কথা ধরুন। আয়তন ২ হাজার ৮৪২ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ। সুরিনামের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৫ লাখ। ভার্জিন আইল্যান্ডের জনসংখ্যা টায়ে-টায়ে ১ লাখ।
জনসংখ্যা পদক জয়ের কোনো শর্ত নয়, তা সত্যি। জনসংখ্যাই বিবেচ্য হলে ভারত-চীনের পদক সংখ্যা বাকিদের ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু ৯ বার অলিম্পিকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ এখনো একটি পদকও, ব্রোঞ্জই সই, জিতবে না—এটা মেনে নেওয়া কঠিন। সমস্যাটা তো সামর্থ্যেও হওয়ার কথা নয়। ভারত ২৮টি অলিম্পিক পদক জিতে ফেলেছে। পাকিস্তান জিতেছে ১০টি। শ্রীলঙ্কা দুটি রুপা হলেও তো জিতেছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে ভুটান-নেপাল-মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশও আছে পদক না-জেতাদের তালিকায়। অলিম্পিক দূরের কথা, বাংলাদেশ এশিয়ান গেমসেই সোনা জিতল ২০১০ সালে, সেটিও ক্রিকেটের সৌজন্যে। এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে কখনো কখনো পদক আসে, কিন্তু সোনা ওই একটিই। কাবাডি-ক্রিকেট দলীয় খেলা। এশিয়ান গেমসে ব্যক্তিগত পদক বাংলাদেশ সর্বশেষ জিতেছিল ১৯৮৬ সালে, বক্সার মোশাররফের সৌজন্যে!
স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র গত রিও অলিম্পিকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। ব্রাজিলের সেই আসরে বিশ্বের নামকরা একটি ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক মিডিয়া ভিলেজে তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন শুধু এই কারণে, ১৬ কোটির বেশি মানুষ নিয়েও বাংলাদেশ যে অলিম্পিকে ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’র মন্ত্রে এখনো উজ্জীবিত তা নিয়ে তিনি লিখতে চান। উৎপল শুভ্র বলেছেন, ‘সেদিন লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে এসেছিল। কিন্তু ওই সাংবাদিককে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, যে দেশে এখনো হ্যান্ড টাইমিং দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া আয়োজনগুলো চলে, সেই দেশে খেলাধুলা নিয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা না-করাই ভালো। নিয়মিত আন্তর্জাতিক আয়োজনের কারণেই ক্রিকেটের অবস্থা ভালো। কিন্তু আর কোনো খেলাতে আমরা আমাদের ক্রীড়াবিদদের সেই ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিতে পারিনি।’
লন্ডন অলিম্পিকের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে উৎপল শুভ্র বলছিলেন, ‘প্রতিটা পদকের জন্য ইংল্যান্ড কত লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে জেনে অবাক হয়েছিলাম। আর আমরা? এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন থাকে, কমনওয়েলথে যদি একটা সোনা জিততে পারি!’
তাঁর কথা প্রতিধ্বনিত হলো ইনাম আহমেদের কণ্ঠে। বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছি, প্রতি বছর আমরা ঈর্ষণীয় জিডিপি অর্জন করছি। কিন্তু শুধু অর্থনীতিই একটা দেশের সব নয়। সময় এসেছে দেশের ভাবমূর্তির জন্য হলেও দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদূত যারা, সেই ক্রীড়াবিদদের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করার।’
ইনাম আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ক্রীড়াবিদের অভাব নেই। আমরা নদীর দেশ, কত কত সাঁতারু। এখানেও তো পরিকল্পনা করে আমরা ভালো করতে পারি। আমাদের ক্রীড়াবিদদের কোনো দোষ বা ব্যর্থতা আমি দেখি না। আমি দেখি সঠিক পরিকল্পনার অভাব। আমরা আশা করি খুব শিগগিরই অলিম্পিক পদকের এই দুঃখটা বাংলাদেশ ঘুচিয়ে দেবে।’
খেলা পাগল বলে পরিচিত ইনাম আহমেদের উদ্যোগের কারণেই এডিবল অয়েল লিমিটেড পৃষ্ঠপোষকতা করছে ফরচুন ট্যুর ডি বাংলাদেশ, ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতারের মতো উদ্যোগের। এ প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য কোনো কৃতিত্ব নিতে চাননি, ‘আমরা দেখেছি কিছু মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক বছর ধরে এমন আয়োজন হয়ে আসছে। আমরা তাই এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করছি। এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বাংলা চ্যানেলের এই ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটারের সাঁতার বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইংলিশ চ্যানেলের সাঁতার নিয়েও কিন্তু এখন ততটা আলোচনা হয় না। আশা করি এ ধরনের উদ্যোগে অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও এগিয়ে আসবে।’