ফিরে কি এলেন সেই সাকিব
তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ব্যাট করতে নেমে ৭ উইকেটে ৩১৪ রান তুলেছে বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসান, লিটন দাস ও ইয়াসির আলী পেয়েছেন অর্ধশতক।
সেই সাকিব কি ফিরে এলেন, যে সাকিব যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন!
ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে? সাকিব যা ইচ্ছে তা-ই করবেন, এটা নতুন কিছু তো নয়। এখানে ফিরে আসারও কিছু নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার আগে ছুটি নিয়েই যা করলেন, সেটা তো তাঁর যা ইচ্ছা তা-ই! এই বলেন টেস্ট থেকে বিশ্রাম চাই তো ওই বলেন, ওয়ানডে খেলবেন না। আবার মনে হলো তো বলে দিলেন, ‘কিছুই খেলব না।’
এত কিছুর পর শেষ পর্যন্ত সাকিবই যখন আবার বলেন, মানসিক অবসাদ দূর হয়ে গেছে। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটাই তিনি খেলবেন। এরপর একা একা বিমানে চড়ে জোহানেসবার্গ চলে আসেন। সকালে পৌঁছে বিকেলে নেমে যান অনুশীলনে—যা খুশি তা করার এর চেয়ে বড় নমুনা আর কী হতে পারে!
সাকিব জোহানেসবার্গে পৌঁছে যাওয়ার পরও তাঁর ছুটি চাওয়া নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনার শেষ বাষ্পটুকুর বুদ্বুদ টের পাওয়া গেছে। সেঞ্চুরিয়নে তো গতকালের মুখ্য আলোচনাই ছিল তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সব ম্যাচে সাকিব খেলবেন কি না, তা নিয়ে।
জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ সুপার স্পোর্ট পার্কের প্রথম ওয়ানডেটি সাকিব খেলছেন এবং এরই মধ্যে আরও একবার যা ইচ্ছে তা করার ক্ষমতাও দেখিয়ে দিয়েছেন। এবার অবশ্য তাঁর শিকার দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। ৬৪ বলে ৭৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটাতে সাকিব যা ইচ্ছে তা-ই করলেন হাতের ব্যাটটা দিয়ে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সর্বশেষ তিন ওয়ানডেতে এটি তাঁর টানা তৃতীয় ফিফটি। আর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের হিসাবে তো আজ ফিফটির ‘ফিফটি’ই করে ফেললেন সাকিব!
সুপার স্পোর্ট পার্কের উইকেটে বাড়তি বাউন্স আছে। তবে সেই বাউন্স অসম নয়, বল ধারাবাহিক উচ্চতায় ব্যাটে আসে। ব্যাটসম্যানের কাজ শুধু জুতসই টাইমিংয়ে বলটাকে ঠিকানামতো পাঠানো। সেটা করেই তামিম ইকবাল-লিটন দাসের ৯৫ রানের উদ্বোধনী জুটিতে দারুণ শুরু পেয়ে গেল বাংলাদেশ দল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। নতুন বলে লুঙ্গি এনগিডি আর কাগিসো রাবাদার প্রথম দুই ওভার কিছুটা অস্বস্তিতে কাটলেও তৃতীয় ওভারেই পাখা মেলতে শুরু করে তামিমের ব্যাট।
এনগিডির অফ স্টাম্পের বাইরে করা শর্ট লেংথের বলে আপার কাটে পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কা, সুপার স্পোর্ট পার্কের লাল-সবুজ গ্যালারিতে প্রথম আনন্দের ঢেউটা তুললেন বাংলাদেশ অধিনায়কই। হ্যাঁ, ম্যাচটাতে যদিও দক্ষিণ আফ্রিকাই স্বাগতিক, খেলা দেখতে আসা দর্শকদের বেশির ভাগই কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি।
দর্শকদের সেই আনন্দের জোয়ারে ধাক্কা লাগে ইনিংসের ২২তম ওভারে। সেঞ্চুরিয়নের সুষম বাউন্সের উইকেটেও পরপর দুই ওভারে দুটি বল একটু নিচু হলো। আর সেই দুটি বলই কেড়ে নিল উইকেটে জমে যাওয়া দুই ওপেনার তামিম ও লিটনের উইকেট। ব্যক্তিগত ৪১ রানে তামিম এলবিডব্লু পেসার আন্দিলে ফিকোয়াওর বলে। পরের ওভারে ৫০ ছোঁয়ার পরের বলেই লিটনের স্টাম্প ভেঙে দেন বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজ।
রানের ঘোড়াটাকে যখন আরও গতি বাড়িয়ে ছোটানোর সময় হলো, তখনই বিনা উইকেটে ৯৫ থেকে বাংলাদেশ ২ উইকেটে ১০৪। মুশফিকুর রহিম এসে গতি বাড়ানোর কাজটা করতে গেলেন নিজস্ব ঢঙে, মানে স্লগ সুইপ খেলে আরকি। কিন্তু মহারাজের বলটা একটু বাড়তি বাউন্স নেওয়ায় ব্যাটে-বলে গড়বড় হয়ে ক্যাচ উঠল আকাশে। অথচ অন্য প্রান্তে সাকিব যে রকম দেখেশুনে খেলছিলেন, সেঞ্চুরিয়নের উইকেটে মুশফিকের একটু ধৈর্যই বাড়িয়ে দিতে পারত তৃতীয় উইকেটে তাদের জুটির দৈর্ঘ্যটা।
সাকিব অবশ্য এরপর আর সঙ্গী দেখার তোয়াক্কা করেননি। বাজে বলগুলোকে যখন যেভাবে খুশি মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন। সাত বাউন্ডারি আর তিন ছক্কার প্রতিটিতেই ছিল যা খুশি তা করার ঔদ্ধত্য। গত বছর জুলাইয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অপরাজিত ছিলেন ৯৬ রানে। এরপর চার ওয়ানডে বিরতি দিয়ে আজ আবার পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংস পেলেন সাকিব।
তাঁকে দেখেই কি না, বাউন্ডারির নেশা পেয়ে বসে ইয়াসির আলীকেও। এর আগে তিন ওয়ানডে খেলে দুটিতে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে রান করেছেন ০ আর ১। রাবাদাকে ফিরতি ক্যাচ দেওয়ার আগে সেই ইয়াসিরই আজ পেয়ে গেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি, চার বাউন্ডারির সঙ্গে যেখানে অলংকার দুটি ছক্কাও।
সাকিব-ইয়াসির দুজনই একসঙ্গে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠায় চতুর্থ উইকেটে তাঁদের ১১৫ রানের জুটিটা হলো মাত্র ৮৩ বলে। এনগিডির বলে উইকেটের পেছনে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লু হয়ে না গেলে সাকিবের যা খুশি তা করার মাত্রাটা নিশ্চয়ই আরও বাড়ত। সঙ্গী ইয়াসিরও যে রকম মারদাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের পক্ষে তখন আরও কঠিন হতো বাংলাদেশের ইনিংসে শৃঙ্খল পরানো।
এমনিতেও সেটা পারেননি তাঁরা। বাংলাদেশের করা ৩১৪ রান বরং মনে করিয়ে দিচ্ছে ওভালে দুই দলের সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচটাকেই। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ বাংলাদেশ ২১ রানে জিতেছিল ৩৩০ রান করে। ব্যাট হাতে সাকিবের যা খুশি তা করার ঔদ্ধত্য ফিরে পাওয়ার দিনে আজ সেঞ্চুরিয়নও কি সে রকম কিছুরই সাক্ষী হতে চলেছে?