পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান যেন বলিউডের সেই নায়ক...
২০০৯ থেকে ২০২০—এ সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে (পিসিবি) সাতজন প্রধান নির্বাচক এসেছেন। কিন্তু ফাওয়াদ আলমকে কেউ জাতীয় দলে বিবেচনা করেননি।
এমন নয় যে ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করতে পারেননি। বরং উল্টোটা—এই ১১ বছর মৌসুমের পর মৌসুম পারফর্ম করে গেছেন ফাওয়াদ। ৫৬.৪৮ গড়ে শুধু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই ছিল ২৬টি সেঞ্চুরি ও ৩৩ ফিফটি।
কিন্তু পাকিস্তান জাতীয় দল এ সময় ৮৮ টেস্ট খেললেও ফাওয়াদ আলমকে দেখা যায়নি। এর মাঝে ৪০ জনের অভিষেক হয়েছে পাকিস্তান দলে। এত পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্যেও জায়গা হয়নি ফাওয়াদের।
ফাওয়াদের টেকনিক নিয়ে একরকম অন্ধ অবিশ্বাস ছিল পাকিস্তান ক্রিকেটে দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের। এই আস্থাহীনতা গত বছরের আগস্টে কীভাবে ভাঙল, সে অন্য গল্প।
ইংল্যান্ড সফরে ডাক পেলেন তিনি। এরপর ছয় মাসের ব্যবধানে তিন টেস্টে পেলেন দুটি সেঞ্চুরি। শেষটি কাল করাচি টেস্টে—ঘরের মাঠে। ২০০৯ সালে টেস্ট অভিষিক্ত ফাওয়াদের বয়স এখন ৩৫, যখন অনেকেই সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবেন।
ওদিকে তাঁর নামের পাশে মাত্র ৮ টেস্ট। ভাবা যায়! ফাওয়াদ নিজেই বলতে পারেন, আর কারও যেন তাঁর মতো ভাগ্য না হয়।
তাঁর কথা শুনলে মনে হবে, ভাগ্য কিংবা নিবার্চকদের এমন পরিহাসের সঙ্গে ফাওয়াদ শান্তি স্থাপন করেছেন। কাল সেঞ্চুরির পর বলেছেন, ‘আমি কাউকে দোষারোপ করি না। সব সময় বলে এসেছি, ভাগ্যে এমন কিছু লেখা থাকলে কেউ আটকাতে পারবে না।’
মোটামুটি পেশাদার পর্যায়ে উঠে আসা যেকোনো ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলা। সেখানে সুযোগ পেয়ে এত দিন ব্রাত্য থাকার জ্বালা সহ্য করে ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক থাকা, ফিটনেস ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
সত্যি বলতে, ফাওয়াদের এই ক্যারিয়ার যেন পুরোনো সিনেমার গল্প—প্রায় পুরো সিনেমায় নায়ক নানা দুঃখ–কষ্ট ও যাতনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর হয়তো শেষ আধা ঘণ্টায় নায়ক সব হিসেব চুকিয়ে নেয়। শেষটা মিলনাত্মক হলেও ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে’ অনুভূতি দর্শকের মনে নাড়া দেয়।
উপমহাদেশে ষাট–সত্তর–আশি এমনকি নব্বই দশকেও এমন ধাঁচের প্রচুর সিনেমা বানানো হয়েছে। বাংলাদেশে এমন চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন, জসীম, ফারুক, রাজ্জাক, ইলিয়াস কাঞ্চন। বলিউডে দিলীপ কুমার, ফারুক শেখ, রাজেশ খান্না থেকে অনেকেই এমন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
হার্শা ভোগলে ফাওয়াদের ক্যারিয়ারকে সিনেমার তেমন চরিত্রের সঙ্গেই তুলনা করলেন। ভারতের এই খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষকের আজকের একটি টুইট দেখুন, ‘ফাওয়াদ আলমের বিষয়ে আরেকটু জানলাম। এ যেন পুরোনো হিন্দি সিনেমা, যেখানে নায়ক ভাগ্যের সব পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে পুরস্কার পান, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
হার্শার এই টুইট এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৪২০ বার রি–টুইট হয়েছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে ১০ হাজারের বেশি।
সেঞ্চুরি করলে ফাওয়াদের উদযাপনের পদ্ধতিটা বাকিদের চেয়ে একটু আলাদা। বাম পা উঁচু করে ডান হাতে ব্যাটটা তুলে বাম হাতটা ঘোড়ার রাশ টানার মতো পেছনের দিকে একটু টানেন।
অনেকের কাছেই এমন উদযাপনের রহস্য জানতে ইচ্ছে হতে পারে। ফাওয়াদ কাল সেই রহস্য ভেঙেছেন সংবাদমাধ্যমে। তুর্কি ড্রাম সিরিয়াল ‘আরতুগ্রুল গাজি’ থেকে এমন উদযাপন বেছে নিয়েছেন ফাওয়াদ। নিউজিল্যান্ড সফরে সেঞ্চুরির পরও এভাবে উদযাপন করেছিলেন তিনি।
ফাওয়াদ বলেন, ‘বিখ্যাত ড্রামা সিরিজ “আরতুগ্রুল গাজি” থেকে এটা নিয়েছি। যুদ্ধ জয়ের পর আরতুগ্রুলের—প্রধান চরিত্র—ঘোড়া (রাশ টেনে) ঘুরিয়ে নেওয়াটা অনুকরণ করি।’
এভাবে উদযাপনের বুদ্ধিটা নিউজিল্যান্ড সফরে মাথায় এসেছিল ফাওয়াদের, ‘নিউজিল্যান্ড সফরে আমি আর আজু ভাই (আজহার আলী) সিদ্ধান্ত নিই, যে–ই সেঞ্চুরি করুক, আরতুগ্রুলের যুদ্ধ জয়ের পর উদযাপন অনুকরণ করব। এরপর সেঞ্চুরি করলাম, তারপর থেকে এটাই আমার নিজস্ব উদযাপন।’
পাকিস্তানি এই ক্রিকেটারের উদযাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদৃত হয়েছে। তাঁর এই উদযাপনকে অনেকেই তাঁর ক্যারিয়ারের যুদ্ধজয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন—বাইশ গজের পর্দায় ১১ বছর ব্রাত্য থাকার যুদ্ধ জিতে ফেরার উদযাপন!