‘পন্ত দুই মাসে যা করেছে, কেউ এক জীবনেও তা পারবে না’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর চার বছর পূর্তি হয়েছে মাসখানেক আগে। এখন পর্যন্ত টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে ৬৪ ম্যাচের। কিন্তু গত মাস দুয়েকে ঋষভ পন্তের নাম যতটা আলোচিত হয়েছে, যত প্রশংসা হয়েছে তাঁর, এর চেয়ে বেশি কিছু কি কখনো ভারতের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান পেয়েছিলেন? সম্ভবত নয়।
অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের ইতিহাস গড়া জয় এনে দেওয়া ইনিংসটা তাঁর। এরপর থেকেই ভারতে তারকা বনে গেছেন পন্ত। আর এবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত চার টেস্টের সিরিজে যা করেছেন, বিশেষ করে আহমেদাবাদে সিরিজের শেষ টেস্টে, এরপর পন্তের তারকা হয়ে যাওয়া নিয়ে সংশয় সামান্যই। ভারতীয় কোচ রবি শাস্ত্রীও এবার উচ্চকিত প্রশংসাই করেছেন পন্তের।
তবে শাস্ত্রীর প্রশংসা শুনে অনেকের হয়তো কোচের আদরের আতিশয্যই মনে হতে পারে। শাস্ত্রীর চোখে, গত দুই মাসে পন্ত ভারতের জার্সিতে যা করেছেন, সেটা এক জীবনেই কারও পক্ষে করা সম্ভব হবে না।
পন্ত যা করেছেন, সেটা যে চোখধাঁধানো, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে শুরু। ‘৩৬’ রানে অলআউট হওয়ার দুঃস্বপ্ন নিয়ে প্রথম টেস্টে হেরে যাওয়ার পরও বিরাট কোহলিকে ছাড়াই চার টেস্টের সিরিজটা অস্ট্রেলিয়া থেকে ২-১ ব্যবধানে জিতে ফিরেছে ভারত। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের টানা দ্বিতীয় টেস্ট সিরিজ জয়ের ইতিহাস গড়ার পথে পন্তের অবদান কে ভুলবে!
ব্রিসবেনে অনেক নাটকের পর হওয়া শেষ টেস্টের শেষ দিনে জিততে ভারতের দরকার ছিল ৩২৪ রান। ৩২৮ রানের লক্ষ্যে আগের দিন ৪ রান নিয়ে দিন শেষ করা ভারতের জন্য এমনিতেই চ্যালেঞ্জটা কঠিন ছিল, তার ওপর রোহিত-রাহানেদের চোখ রাঙাচ্ছিল ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার ৩২ বছরের অজেয় থাকার রেকর্ড।
সব চূর্ণ হয়ে গেল পন্তের চোখধাঁধানো এক ইনিংসে! ১৩৮ বলে ৯ চার ও ১ ছক্কায় ৮৯ রানে অপরাজিত ছিলেন পন্ত, দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। ভারতের জয় যখন নিশ্চিত হচ্ছে, দিনের তখন আর বাকি ছিল ৩ ওভার!
একদিক থেকে ব্রিসবেনে চতুর্থ টেস্টে একটা আক্ষেপই ভুলেছিলেন পন্ত। সিডনিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ৪০৭ রানের লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত ভারত জিততে পারেনি, ড্র করেছে, তবে ১১৮ বলে ১২ চার ও ৩ ছক্কায় ৯৭ রান করা পন্ত যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, অবিশ্বাস্য কিছুর স্বপ্ন ছিল ভারতের।
এ তো গেল অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। দেশ বদলেছে, কন্ডিশন বদলেছে, বদলেছে প্রতিপক্ষও। কিন্তু নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চলতি সিরিজেও পন্তের ব্যাটে দ্যুতিতে কোনো অদল–বদল হলো না। চেন্নাইয়ে প্রথম দুই টেস্টে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে দুটি ফিফটি। দুই দিনে শেষ হওয়া তৃতীয় টেস্টে বোলারদের দাপটের মধ্যে পন্তের ব্যাটিংয়ের আর দরকার পড়েনি। কিন্তু চতুর্থ টেস্টেই আরেকবার নিজেকে চেনালেন পন্ত। ভারতের ইনিংস ব্যবধানে জয়ের ভিত গড়ে দিল ২৩ বছর বয়সী উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের ঝোড়ো সেঞ্চুরি।
১১৮ বলে ১০১ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসটা এসেছেও কোন অবস্থায়! প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ২০৫ রানের জবাবে ১৪৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ভারতকে ম্যাচে চালকের আসনে ফিরিয়ে এনেছে সপ্তম উইকেটে ওয়াশিংটন সুন্দরের সঙ্গে পন্তের ১১৩ রানের জুটি।
সুন্দরও দারুণ ব্যাটিং করেছেন, অষ্টম উইকেটে অক্ষর প্যাটেলের সঙ্গে আরেকটা সেঞ্চুরি জুটি গড়েছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সঙ্গীর অভাবে ৯৬ রানে অপরাজিত থাকতে হয়েছে। তবে সুন্দর নয়, ম্যাচের আগে-পরে সব প্রশংসা পাচ্ছেন পন্তই। সেটি যতটা তাঁর ইনিংসের জন্য, তার চেয়েও বেশি ইনিংসের ধরনের জন্য!
ঝোড়ো ইনিংসটা সম্ভবত টি-টোয়েন্টির যুগের টেস্ট ব্যাটিংয়েরই নিদর্শন, হয়তো আগামী দিনের টেস্ট ক্রিকেটে এমন ব্যাটিংই নিয়মিত হবে। আর সে ইনিংসের পথে ৮৯ রানে থাকার সময় যেভাবে ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার জেমস অ্যান্ডারসনকে রিভার্স স্কুপ করেছেন, সেটি চোখ ধাঁধিয়েছে!
রিভার্স শটটা কতটা ঠিকভাবে হয়েছে, ব্যাটে ঠিকমতো লেগেছে কি না, নাকি শুধু অ্যান্ডারসনের গতির কারণেই বলটা বাউন্ডারি পার করাতে পেরেছেন পন্ত—এসব ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এভাবে ভাবতে পারাই তো অনেক বড় ব্যাপার! এরপর সেঞ্চুরিটা পন্ত পূরণ করেছেন ছক্কা মেরে। এমনি এমনিই তো আর ভারতের কিংবদন্তি অধিনায়ক ও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) বর্তমান সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী বলেননি, এভাবে চালিয়ে গেলে পন্ত ক্রিকেটে সেরাদের একজন হবেন।
ভারতের কোচ শাস্ত্রী অবশ্য ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানেই পন্তকে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রাখছেন। নিজের ক্যারিয়ারের সঙ্গে পন্তের পথচলা মিলিয়ে আজ এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শাস্ত্রী বললেন, ‘২১ বছর বয়সে আমারও সাফল্য এ রকমই ছিল। এই ছেলেরা কী দারুণ কিছু করে দেখিয়েছে, সেটি তাই ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।’
গত আইপিএলটা ভালো কাটেনি পন্তের। গড়পড়তাও বলা যায় না। কিন্তু এরপর পন্ত যেভাবে ফিরে এসেছেন, তাতেও মুগ্ধ শাস্ত্রী, ‘হ্যাঁ, আইপিএলে খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি ওর। কিন্তু এরপর ও অন্য যে কারও চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে। সেটির ফল কী হয়েছে, তা শুধু ও-ই নয়, পুরো বিশ্বই দেখেছে।’
এরপরই শাস্ত্রীর উচ্চকিত প্রশংসা, ‘ওর মতো ম্যাচ জেতানোর মতো দারুণ সহজাত ক্ষমতার অধিকারী একজনকে নিজের প্রতিভার দাবি মেনে খেলতে দেখা ক্রিকেটের জন্যই দারুণ এক দৃশ্য। আমার মনে হয় গত দুই মাসে ভারতের জন্য পন্ত যা করেছে, সেটা কেউ এক জীবনেও পারত না। ওর কিপিংও ছিল দারুণ।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ৩-১ ব্যবধানে জেতা ভারত এখন আহমেদাবাদে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ টি-টোয়েন্টির সিরিজ খেলবে, যেটি শুরু হবে ১২ মার্চ। আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজে জয়ের ফলে আগামী জুনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলবে ভারত। লর্ডসে সে ম্যাচ হবে ১৮-২২ জুন।