নিজের শেষ দেখছেন বাংলাদেশ কোচ?

স্টিভ রোডসকে নিয়ে বিসিবিতে আছে অসন্তুষ্টি। ছবি: শামসুল হক
স্টিভ রোডসকে নিয়ে বিসিবিতে আছে অসন্তুষ্টি। ছবি: শামসুল হক
>

বাংলাদেশ কোচ স্টিভ রোডসকে নিয়ে বিসিবির মধ্যে আছে অসন্তুষ্টি। কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করেন কাউন্টি দলের কোচ হিসেবে যোগ্য হলেও জাতীয় দলের কোচ হওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই। পথপ্রদর্শনের নেতৃত্বগুণও নাকি নেই তাঁর!

‘আমাকে আর ছয় মাস রাখলে আমি বাংলাটা আরও ভালোভাবে শিখে ফেলতাম’-আফগানিস্তান ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন শেষে রসিকতা করলেন বাংলাদেশ দলের কোচ স্টিভ রোডস। শুনে বাংলাদেশের এক সাংবাদিকদের পাল্টা রসিকতা, ‘আপনি আমাদের বিশ্বকাপ এনে দিন। আপনাকে আমরা আরও ছয় বছর রেখে দেব।’

কিন্তু রসিকতার ছলেই-বা হঠাৎ রোডস ওই কথা কেন বলবেন! বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সঙ্গে তাঁর চুক্তি আগামী বছর অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তাহলে মাত্র ছয় মাসের চিন্তা কেন আসবে ইংলিশ কোচের মনে? তবে কি স্টিভ রোডসও বুঝে গেছেন, বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে এই বিশ্বকাপের পরই শেষ দেখে ফেলতে পারেন তিনি!

না, এখনো সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিসিবি। কিন্তু আড়ালে-আবডালে প্রসঙ্গটা আসছেই। জাতীয় দলের ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে দেশ থেকে বিশ্বকাপ দেখতে আসা বিসিবি কর্তাদের আলোচনা-সর্বত্রই রোডসকে নিয়ে অসন্তুষ্টি। বিসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে জাতীয় দলের অনেক সদস্যও একমত-কাউন্টি দলের কোচ হিসেবে হয়তো যোগ্য উস্টারশায়ারের সাবেক এই কোচ। কিন্তু জাতীয় দলের কোচ হওয়ার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা তাঁর নেই। রোডসের মধ্যে নেই বাংলাদেশের মতো উন্নতির সিঁড়িতে থাকা একটা দলের পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো নেতৃত্বগুণও।

রোডস মানুষ হিসেবে অতি নরমসরম। বিশ্বকাপের আগে কোচিং স্টাফকে শক্তপোক্ত করতে একপর্যায়ে তো ডিরেক্টর অব কোচেস পদ দিয়ে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ড্যারেন লেম্যানকে দলের সঙ্গে যুক্ত করারও চিন্তা করেছিল বিসিবি। তবে বিশ্বকাপের আগে এ ধরনের সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত হতে পারে। কোচদের মধ্যে তৈরি হতে পারে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। এসব আশঙ্কা থেকে চিন্তাটি আর বাস্তবতার দেখা পায়নি।

দলের ওপর কর্তৃত্বের অভাব, ভালো গেমপ্ল্যান তৈরি করতে না-পারা, ম্যাচ পরিস্থিতির দাবি মেনে মাঠে সঠিক বার্তা পাঠাতে ব্যর্থতা-মূলত এই ব্যাপারগুলোই প্রশ্ন তুলছে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে রোডসের যোগ্যতা নিয়ে। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয় ও বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোতেও কোচের ভূমিকা সামান্যই মনে করে বোর্ড এবং ক্রিকেটারদের অনেকে। জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারের মন্তব্য, ‘উনি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু ভালো কোচ নন। টিম মিটিংয়ে উনি নিজে একটা ব্রিফ পর্যন্ত দেন না। দলের কেউ তাকে ভয় পায় না, কোচের যেটুকু সম্মান পাওয়া উচিত, সেটুকুও তিনি পান না।’

টিম মিটিংয়ে খেলোয়াড়দের গেমপ্ল্যান বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটা নিয়মিতই করে আসছেন দলের কম্পিউটার-বিশ্লেষক শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন। কোচ থাকেন নির্বাক¯শ্রোতার ভূমিকায়। অথচ হওয়ার কথা উল্টোটি। সাধারণত প্রতিপক্ষ ও নিজেদের খেলোয়াড়দের তথ্য-পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করে কম্পিউটার-বিশ্লেষকেরাই গেমপ্ল্যানের ছক এঁকে দেন। নিজের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রধান কোচ সেটিকে আরও নিশ্ছিদ্র করে তুলে খেলোয়াড়দের তা বুঝিয়ে দেন। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে সেই দিন গত হয়েছে অনেক দিন। গেমপ্ল্যান তৈরি থেকে সেটি খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটাও এখন করছেন সম্প্রতি বিসিবির চাকরিতে স্থায়ী হওয়া ভারতীয় কম্পিউটার-বিশ্লেষক শ্রীনিবাস।

২০১৭ সালের শেষ দিকে চুক্তির মাঝপথে বাংলাদেশ কোচের চাকরি ছেড়ে দেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। নতুন কোচ খুঁজতে পিটার কারস্টেনকে প্রায় ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে দায়িত্ব দেয় বিসিবি। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারের পরামর্শেই গত বছরের জুন মাসে প্রায় ২৩ হাজার ডলার বেতনে ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিসিবি রোডসকে জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেয়। ইংল্যান্ডের হয়ে ১১টি টেস্ট ও ৯টি ওয়ানডে খেলেছেন সাবেক উইকেটকিপার রোডস। উস্টারশায়ারের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন সাকিব আল হাসানের সঙ্গে। এর বাইরে রোডসের সবচেয়ে বড় খ্যাতি-তিনি একজন ভালো মানুষ। হাথুরুসিংহের সঙ্গে একটার পর একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার পর পরবর্তী কোচের মধ্যে এই গুণটিও দেখতে চেয়েছিলেন বিসিবি ও খেলোয়াড়েরা।

কিন্তু রোডসের অতিরিক্ত ভালোমানুষিটাই এখন তাঁর বিপক্ষে যাচ্ছে। নিয়োগ দেওয়ার সময় কোচ রোডসের মধ্যে বিসিবি এমন কিছু খুঁজে পেয়েছিল, যা ছিল না হাথুরুসিংহের চরিত্রে। হাথুরুসিংহের অতিরিক্ত কঠোর আচরণ অনেককেই অনেক সময় আঘাত দিয়েছে। নতুন কোচও সে রকম হোক, তা চায়নি বোর্ড। কিন্তু এখন নতুন সমস্যা, ভালো কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহের মধ্যে যা ছিল, সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না রোডসের মধ্যে। খেলোয়াড়দের নিজ থেকে ডেকে কখনোই কিছু বলেন না তিনি। দেন না কোনো পরিকল্পনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির এক পরিচালকের মন্তব্য, ‘কোচের আরও শক্ত হওয়া উচিত, যেটা হাথুরুসিংহের মধ্যে ছিল। শুধু ভালো মানুষ দিয়ে তো হবে না, ভালো কোচ হতে হবে। কথা না বললে, একটু কঠোর না হলে, খেলোয়াড়েরাও তো তাকে সমীহ করবে না।’ শুধু তা-ই নয়, হাথুরুসিংহেকে আবার ফিরিয়ে আনার গুঞ্জনও শোনা যায় কান পাতলে। যদিও বিসিবির এক পরিচালক সে সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘নতুন কোচ পেতে হয়তো সমস্যা হবে। তবে যে গেছে তাকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রশ্নই ওঠে না।’

দল ভালো খেলার পরও কোচকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা অস্বাভাবিকই। বিসিবিও তাই ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্যে বিষয়টিতে হাত দিতে চাচ্ছে না। তা ছাড়া ভালো একজন নতুন কোচ খুঁজে পাওয়াটাও তো সহজ নয়। এ নিয়ে তাই সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ। তবে স্টিভ রোডসের আকাশে উড়তে থাকা সমালোচনার বাষ্প পূর্বাভাস দিচ্ছে, বাংলাদেশ দলে তাঁর সময় হয়তো শেষই হয়ে আসছে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠলেই কেবল একটা ‘লাইফলাইন’ পেতে পারেন তিনি। সেটিও অবশ্য তখনই হবে, যখন দলের সাফল্যে কোচের ভূমিকা খুঁজে পাবেন বোর্ড ও খেলোয়াড়েরা।