নতুনের প্রতি আগ্রহ কার না থাকে! আজও সে আগ্রহ নিয়েই দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকবেন সবাই। অস্ট্রেলিয়া নয়তো নিউজিল্যান্ড—টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পাবে নতুন চ্যাম্পিয়ন। কেইন উইলিয়ামসন নাকি অ্যারন ফিঞ্চ, কার হাতে উঠবে প্রথমবারের মতো টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি?
কিন্তু এসবের প্রতি আগ্রহ ফাইনালের শহর দুবাইয়ে কতটা আছে? গত প্রায় ২০ দিন এই শহরে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে পূর্বানুমান, বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে অন্তত এখানকার মানুষের মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য থাকবে না। যাঁরা ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা বড়জোর রাতে কাজ সেরে ঘরে ফেরার সময় মুঠোফোনের স্ক্রিনে কৌতূহলী দৃষ্টি রাখতে পারেন—খেলায় যেন কী হলো!
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ক্রিকেট উপমহাদেশীয় প্রবাসীদের কাছে একটা উৎসবের মতো। করোনাভাইরাসের কারণে ভারতের বিশ্বকাপটা আমিরাতে চলে আসায় তাঁরা সুযোগ পেয়েছিলেন আরও একবার তাতে মেতে ওঠার। ভারত, পাকিস্তানের বিদায়ে সে উৎসব এরই মধ্যে শেষ। ফাইনালের মঞ্চে যখন উপমহাদেশেরই কোনো প্রতিনিধি নেই, সেখানে কে চ্যাম্পিয়ন হলো, তাতে তাদের কিই–বা আসে যায়!
আলো ঝলমলে এই শহরের সাধারণ মানুষের কাছে অবশ্য ১৯২ দেশের অংশগ্রহণে ‘দুবাই এক্সপো–২০২০’–এর মতো আয়োজনও নাকি ‘ফ্লপ শো’তে রূপ নিয়েছে। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে মানুষের যা–ও একটু আগ্রহ ছিল, অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালে ওঠার রাতে পটকা–আতশবাজিতে সেটিরও ‘বিদায়ী সংবর্ধনা’ ঘটে গেছে।
বিরাট কোহলির দল সুপার টুয়েলভ থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকেই এখানকার ভারতীয়রা চাতক পাখির মতো আশায় ছিল, পাকিস্তান যেন বিশ্বকাপের ফাইনালে না যায়। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে সেই অপেক্ষার মধুর সমাপ্তির উপলক্ষটা তারাই উদ্যাপন করেছে পটকা–আতশবাজি ফুটিয়ে।
একটা কথা অবশ্য নিশ্চিত করেই লিখে দেওয়া যায়—অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড যে দলই চ্যাম্পিয়ন হোক না কেন, দুবাইয়ে আজ কোনো উৎসব হবে না। মাঠে হয়তো আতশবাজি পুড়বে, কিন্তু সেটা তো ওমান–আমিরাত মিলে এক মাস ধরে হওয়া টুর্নামেন্টের শেষটাকে বর্ণাঢ্য করতে আইসিসির দায়।
এই যে এতগুলো ম্যাচ হলো, তাতে গ্যালারিতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের দর্শক ছিল হাতে গোনা। দুই দেশের কঠিন কোভিড নীতির কারণে তাদের কোনো সাংবাদিকও টুর্নামেন্ট কাভার করতে আসেননি। অন্তত ফাইনালের আগপর্যন্ত কোনো ম্যাচেই দেখা যায়নি অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের কোনো সাংবাদিককে।
মাঠে খেলাটা যাঁরা খেলবেন, তাঁদের অবশ্য বাইরের এই অনাগ্রহ নিয়ে ভাবলে চলবে না। বরং এই দুই দল, এই দুই দেশের মানুষ এবং সারা বিশ্বের ক্রিকেট অনুরাগীদের কাছেও অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ড ফাইনালের আলাদা মাহাত্ম্য আছে। ১৯৮১ সালের ‘আন্ডারআর্ম’ বিতর্কের পর থেকে দুই দেশের ক্রিকেটে বহমান অদৃশ্য ‘শত্রুতা’ তার একটা কারণ অবশ্যই। এরপর থেকে এই দল যখনই নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নেমেছে, তাতে ভর করেছে বাড়তি রোমাঞ্চ। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করতে হলে বলতে হয়—ক্রিকেট মাঠে অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়াটা যেন তাসমানপারের ‘ভারত–পাকিস্তান’ লড়াই।
এই দুই দলের ফাইনালের ইতিহাস বলবে, আজকের ম্যাচে কিউইদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে অসিরা। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার এটি দ্বিতীয় ফাইনাল, আর নিউজিল্যান্ড ফাইনালে উঠল এবারই প্রথম। ২০১০ সালের আসরে ফাইনালে উঠেও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে সর্বোচ্চ পাঁচবার। নিউজিল্যান্ড সেখানেও মাত্র দুবার ফাইনালে উঠে দুবারই রানার্সআপ।
তবে খেলাধুলায় ইতিহাস একটা বাড়তি অনুপ্রেরণা মাত্র। পুরোনো সংখ্যার হিসাব শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে অনুমানেরই খোরাক। ভবিষ্যৎ যখন বর্তমানে চলে আসে, তখন অনেক কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না। মাঠের পারফরম্যান্সটাই হয়ে ওঠে আসল। আজ নিউজিল্যান্ডের সামনে তাই সুযোগ আছে তাদের পোড় খাওয়া অতীতকে বদলে দেওয়ার।
কয়েক বছর ধরেই ক্রিকেটের অভিজাত শ্রেণিতে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। কখনো পারছে, বেশির ভাগ সময়ই পারছে না। এ বছর ভারতকে হারিয়ে তারা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে। কিন্তু অতৃপ্তি রয়ে গেছে সাদা বলে। ২০১৫ সালের মূল বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে ফিরতে হয়েছে শিরোপার সুবাস নিয়েই। এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে তো ট্রফিটাকে রেখে আসতে হয়েছে হাতছোঁয়া দূরত্বে! ম্যাচ টাই করেও লর্ডসে ইংল্যান্ডের কাছে হার মানতে হয়েছিল কম বাউন্ডারি মারার অদ্ভুত নিয়মের ফেরে পড়ে।
পরপর দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে আহত বাঘ হয়ে ফেরা নিউজিল্যান্ড যখন আরও একবার ফাইনালে উঠে টি–টোয়েন্টির বিশ্বসেরার ট্রফিতে চোখ রাখতে পারছে, বুঝে নিতে হবে ক্রিকেটের অভিজাত শ্রেণিতে পা রাখার যোগ্য দাবিদারই হয়ে উঠেছে দলটা। ওপরে ওঠার সিঁড়িতে যারা নিয়মিত কাঁটা বিছিয়ে দিত, এবার তো নিউজিল্যান্ড সেই ইংল্যান্ডেরও স্বপ্ন মাড়িয়ে দিয়েছে সেমিফাইনালে। ২০১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড হয়তো সাদা বলের ক্রিকেটের দুই সিংহাসনের একটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। কিন্তু আজ পাশের সিংহাসনটিতে যে কেইন উইলিয়ামসনই বসে পড়বেন না, তা কে বলতে পারে!
ইংল্যান্ডের তাতে বাধা দেওয়ার আর কোনো উপায় না থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার আছে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটের ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা আজ ২০ ওভারের ক্রিকেটের অপূর্ণতা দূর করতেই মাঠে নামবে। সব রকম অতীতও তাদেরই পক্ষে। একটা তথ্যেই সেটার সারাংশ দিয়ে দেওয়া যাক। ১৯৮১ সালের পর অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ড নকআউট ম্যাচ বলতে অস্ট্রেলিয়ারই জয়। গত ৪০ বছরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ১৬ বার নকআউট পর্বে খেলে একবারও জেতেনি নিউজিল্যান্ড।
কিন্তু ওই যে বললাম, ইতিহাস সব সময় বর্তমানের ছবি এঁকে দিতে পারে না। দুবাইয়ের আলোর রোশনাইয়ে আজ তাই দেখা যেতে পারে নতুন নিউজিল্যান্ডকেও।