নাসুম যেন মিরপুরের বাঘ

মিরপুরের উইকেট নাসুম প্রতিপক্ষের বড় দুশ্চিন্তার নামছবি: শামসুল হক

ফিন অ্যালেন চাইলেও তাঁকে ভুলতে পারবেন না। ঘরোয়া ক্রিকেটে উড়ন্ত সূচনার জন্য বিখ্যাত এই ব্যাটসম্যানকে গত মার্চে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ দেয় নিউজিল্যান্ড। হ্যামিলটনে নন-স্ট্রাইকে ছিলেন অ্যালেন। ষষ্ঠ বলে প্রথম স্ট্রাইকে এলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বল স্টাম্প উপড়ে নিল অ্যালেনের। বোলার? সেদিন তাঁর মতোই আরেক অভিষিক্ত নাসুম আহমেদ।

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলছেন, সেখানে পাওয়ারপ্লেতে বল করতে এসে ১ ওভারে মাত্র ১ রান দিয়ে ১ উইকেট। অভিষেক নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখে থাকলে এমন কিছুই দেখার কথা নাসুমের। সে সুখস্বপ্ন অবশ্য এক সপ্তাহের মধ্যেই গায়েব। প্রতিপক্ষের মাঠ ও উইকেট নাসুমের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল কিছুদিনের মধ্যেই। পরিসংখ্যান দেখলে দলে জায়গা পাচ্ছেন কেন—সে প্রশ্নও উঠে যেত হয়তো। ভাগ্যিস অস্ট্রেলিয়া সে সময়েই সফরে এসেছিল!  

ঘরের উইকেটে খেলার সুযোগ পেয়েই বাঁহাতি স্পিনার নাসুম হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর। মিরপুরের উইকেটে বাঘ হয়ে উঠেছেন নাসুম।

আফগান ব্যাটিং লাইনআপকে আজ একাই আটকে ফেলেছেন নাসুম
ছবি: প্রথম আলো

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মার্চের সিরিজের শুরুটা ভালো হলেও শেষটা হয়েছে উল্টো। অকল্যান্ডের ১০ ওভারের ম্যাচ শেষে তাঁর ক্যারিয়ার গড় দেখাচ্ছিল ৪২, স্ট্রাইক রেট ৩০। পাওয়ারপ্লেতে উইকেট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রান আটকানোর দায়িত্ব থাকে তাঁর। ওভারপ্রতি ৮.৪ রান বলছিল, সে কাজটাও সেভাবে হচ্ছে না তাঁর।

জুলাইয়ে জিম্বাবুয়ে সফরেও আশানুরূপ কিছু করে দেখাননি নাসুম। উল্টো জিম্বাবুয়ে থেকে ঘুরে আসার পর তাঁর পরিসংখ্যান আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। ৪ টি-টোয়েন্টি শেষে মাত্র ২ উইকেট। উইকেট পেতে তাঁর খরচ ৬০.৫০ রান। এক একজন ব্যাটসম্যানকে ফেরাতে সাড়ে ৬ ওভার বল করতে হচ্ছে। ওভারপ্রতি রান দিচ্ছেন ৯.৩০ করে। ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে লিটন, সৌম্য, তাসকিন এনামুলদের সঙ্গীর শুরুটা ভালো হয়নি মোটেও।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই প্রথম জ্বলে উঠেছেন নাসুম
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতীয় দলে এসেছেন। বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গীদের অনেকেই বহু আগে জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় নাম। ওদিকে নাসুম আহমেদ যুব দল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই বিস্মৃত এক নাম। তাঁর চলাফেরাও একটু ভিন্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব উপস্থিতি নেই, নিয়ম করে পান খান, সফরে পান খেতে পারেন না বলে মনে হাপিত্যেশ থাকে। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নবাণের মুখে সহজ স্বীকারোক্তি করেন, ‘আমাদের দিয়ে হচ্ছে না’ বলে। এমন একজনের জন্য আলোর ভাগ পাওয়া কঠিন। অবশেষে যখন নজরে এসেছেন, তখন নতুন বাধা করোনাভাইরাস। সেসব পেছনে ফেলে জাতীয় দলে এলেন, আর অভিষেক হলো সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ পরিবেশে।

নাসুম হাল ছাড়েননি। বিসিবিও একটু সাহায্য করল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ঘরের মাঠে খেলার সুযোগ এল, আর সেবারই পেলেন ফিঙ্গার স্পিনারদের জন্য স্বপ্নের উইকেট। ৪-০-১৯-৪, নাসুমের এক স্পেলেই কাবু অস্ট্রেলিয়া। এই সংস্করণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়টাও এল নাসুমের হাত ধরে। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে আর নাসুম ধাঁধা কাটিয়ে ওঠা হয়নি অস্ট্রেলিয়ার।

মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও দুর্দান্ত ছিলেন নাসুম
ছবি: প্রথম আলো

সে ধাঁধা বুঝে উঠতে পারেনি নিউজিল্যান্ডও। ৪ উইকেটের এক স্পেল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের সূচনা হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নাসুমের আরেক ৪ উইকেটের স্পেল সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিল। সেদিন আরও ভয়ংকর এই বাঁহাতি। ৪ ওভারে মাত্র ১০ রান দিয়ে ৪ উইকেট পেয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে গিয়েছিল ৯৩ রানে।

আজ আফগানিস্তান ১ রান বেশি করেছে। সিরিজের প্রথম ম্যাচে সফরকারীরা অলআউট হয়েছে ৯৪ রানে। এর দায় অবশ্য নাসুমের নয়। আগস্টের সে ম্যাচের মতো, আজও ১০ রান দিয়ে ৪ উইকেট পেয়েছেন নাসুম।

আজকের কীর্তিটা আরও বেশি তৃপ্তি দেবে। কারণ, আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মতো উইকেট আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। প্রতিপক্ষ দলও অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের প্রায় দ্বিতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের মতো স্পিন শুনলেই ভয়ে কাবু হয়ে পড়ে না। অনুশীলনে রশিদ-মুজিব-কায়েস-নবীদের নিয়মিত খেলা এক দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ওভারপ্রতি ২.৫ রান দেওয়া বা ১ উইকেট পাওয়া; যেকোনো হিসেবেই দুর্দান্ত।

১৫ বলের মধ্যে ৪ উইকেট পেয়েছেন নাসুম
ছবি: প্রথম আলো

আজ প্রথম ১৫ বলেই ৪ উইকেট পেয়ে গেছেন। শেষ ৯ বলে আর ১ উইকেট পেলেই চতুর্থ বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচে পাঁচ উইকেট পাওয়ার কীর্তি হতো তাঁর।

সেটা আজ হয়তো হয়নি, কিন্তু মিরপুরে নাসুমের পারফরম্যান্স তেমন কিছু দেখার আশা বাঁচিয়ে রাখছে। এখন পর্যন্ত মিরপুরে ১২ ম্যাচ খেলেছেন। তাতে তিনবার ৪ উইকেট পেয়েছেন। মাত্র তিন ম্যাচে কোনো উইকেট না নিয়ে ফিরেছেন। মাত্র দুবার বলের চেয়ে রান বেশি দিয়েছেন। ১২ ম্যাচে ৯.৪৫ গড়ে ২০ উইকেট পেয়েছেন। প্রতি ১২ বলে ১ উইকেট। ওভারপ্রতি রান দেওয়ার হারও ঈর্ষণীয়। পাওয়ারপ্লেতে বল করে ৪.৭২ রান খরচ যেকোনো অধিনায়ককে তৃপ্তি দেবে।

সে তুলনায় মিরপুরের বাইরের নাসুম বেশ ম্লান। ৭ ম্যাচ খেলে মাত্র ৬ উইকেট, সেটাও ৩৩ গড়ে। প্রতি ২০.৮৩ বলে এক উইকেট ও ওভারপ্রতি ৯.৫১ রান দেওয়াও উন্নতির জায়গা দেখিয়ে দেয়।

আপাতত তাই মিরপুরের বাঘ বলেই মনে হচ্ছে নাসুমকে। অবশ্য এক বছর আগেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলা এক বোলারের ক্ষেত্রে সেটাও মন্দ কী!