ক্রাইস্টচার্চে এসে ডানেডিনের গল্প লিখছি। কাল দুপুরে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে একই ফ্লাইটে ডানেডিন থেকে ক্রাইস্টচার্চে এলাম। পর্যটকের মতো ঘুরে কাটানো ক্রাইস্টচার্চের বিকেলটা ডায়েরি লেখার অনেক রসদই সরবরাহ করেছে। তারপরও ডানেডিনে পড়ে থাকার কারণ একটাই। ক্রাইস্টচার্চে তো আরও তিন দিন আছি। সেসব পরেও লেখা যাবে। ডানেডিন পর্বটার আগে সমাপ্তি টানি।
নিউজিল্যান্ডে খেলা কাভার করার সবচেয়ে বড় শান্তি হলো, এখানে মন দিয়ে খেলাটা দেখা যায়। সময় পার্থক্যের কারণে খেলা শেষ হওয়ার পরও হাতে অফুরন্ত সময় থাকে লেখার। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা বা জিম্বাবুয়ের মতো এক চোখ খেলার দিকে রেখে ম্যাচ চলার সময়ই লেখা শুরু করতে হয় না। পত্রিকার ডেডলাইন যে ওসব দেশে বিকেল হতে না হতেই শেষ!
একটাই সমস্যা, নিউজিল্যান্ডে লেখার জন্য রাত জাগতে হয়। আমার মতো যাঁদের ডেডলাইনের চাপ ছাড়া লেখা হয় না, তাঁদের ঘুমাতে ঘুমাতে ভোরও হয়ে যায়। লিখি বাংলাদেশের সময় মাথায় রেখে, কিন্তু প্র্যাকটিস বা ম্যাচে যেতে হয় নিউজিল্যান্ড সময় অনুযায়ীই, সমস্যাই বটে! এটা যদি অসুবিধা হয়, সুবিধা হলো, সবকিছু একটু আয়েশি ভঙ্গিতে করা যায়। মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার ট্যাক্সি পেতে একটু দেরি হলেও সেটি এমন কোনো অস্থিরতার কারণ হয় না। কাল ডানেডিনে তৃতীয় ওয়ানডের পরই যেমন আমি স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত সমাহিত রূপ নিয়ে ট্যাক্সির জন্য চেষ্টা করে অপেক্ষা করছি। মাশরাফি বিন মুর্তজা আর টিম সাউদির সংবাদ সম্মেলন করে ইউনিভার্সিটি ওভাল থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা আটটার মতো বেজে গেছে। হ্যাঁ, সন্ধ্যা আটটাই! গ্রীষ্মকালে এখানে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। কখনো আরও কিছুক্ষণও। সন্ধ্যা লেখার পরই তাই মনে হচ্ছে, লেখা উচিত আসলে ‘বিকেল ৮টা’।
মোবাইলে ট্যাক্সি কোম্পানির নম্বরে ফোন করে যাচ্ছি আর সেটি লিটন দাসের মতো আশ্চর্য ধারাবাহিকতা দেখিয়ে বলে যাচ্ছে, সব অপারেটর এখন ব্যস্ত। যতই ‘শান্ত সমাহিত’ ছিলাম বলে দাবি করি না কেন, একটু বিরক্তি তো লাগছিলই। পরে অবশ্য ‘যা হয় ভালোর জন্যই হয়’ আপ্তবাক্যে আরও বিশ্বাস এসে গেল! সময়মতো ট্যাক্সিটা পেয়ে গেলে তো নতুন একটা ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হতো না। শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সি কোম্পানির লাইন পেয়ে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময় রাস্তার ওপারে অদ্ভুত একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। তরুণ-তরুণীর বিশাল এক জমায়েত। সবার পরনে একই পোশাক। সেই পোশাকও খুব বিচিত্র। এক টুকরা ধবধবে সাদা কাপড় কোনো রকমে গায়ে জড়ানো। সেটির ওপর সবুজ পাতায় ভরা লতানো কোনো একটা গাছের ডাল। কারও কাঁধ থেকে শরীরে। কারও বা জড়ানো কোমরে। এদিক থেকে ওদিক থেকে আসছে আরও অনেকে এবং ক্রমেই ভিড়টা বাড়ছে। মানুষের যে কখন কী মনে হয়, তা একটা রহস্য বটে। হইচই করতে থাকা শ্বেতশুভ্র পোশাকের ওই ছেলেমেয়েদের দেখে আমার যেমন সৈয়দ আবুল মকসুদের কথা মনে পড়ে গেল। গান্ধীর অনুসারী হয়ে অনেক দিনই যিনি সেলাই ছাড়া একটা সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়েই পোশাকের কাজ সারছেন। হঠাৎ মনে হলো, মকসুদ ভাই এখানে থাকলে অনায়াসে ওই দলে মিশে যেতে পারতেন। যদিও এদের বেশির ভাগেরই গায়ের সাদা বস্ত্রখণ্ড মকসুদ ভাইয়ের তুলনায় অনেক বেশি সংক্ষিপ্ত। যা দেখে আমার আরও বেশি শীত করতে লাগল।
বাংলাদেশের মতো এটি ষড়্ঋতুর দেশ নয়। এখানে ঋতু চারটি। ডানেডিনের একটা দিনই আপনাকে সেই চার ঋতুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে—এ কথা তো এই ডায়েরিতে আগেই লিখেছি। বাকি দুটি ঋতু সেভাবে টের পাইনি, তবে কালকের তৃতীয় ওয়ানডের সময় কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই গ্রীষ্ম আর শীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ডানেডিন। দুপুর পর্যন্ত প্রচণ্ড গরম। ছোট্ট একটা খোপের মতো প্রেসবক্সে বসে রীতিমতো গরমে হাঁসফাঁস করেছি। এসিটেসির কোনো বালাই তো নেই-ই, ফ্যানও নেই। হয়তো সেটির প্রয়োজন পড়ে না বলেই। ডানেডিনে টিম হোটেল চার তারকা মানের। সেটিতেও এসি নেই। ক্রিকেটাররা এ নিয়ে একটু বিরক্তও ছিলেন। গ্রীষ্মের হঠাৎ করেই শীতে রূপান্তরের কথা বলছিলাম। লাঞ্চের সময় প্রেসবক্স থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি, কনকনে বাতাস বইছে। তাপমাত্রাও নেমে গেছে ধপ করে। খেলা শেষে মাঠ থেকে বেরোনোর পর তো গায়ে ভারী জ্যাকেটই চড়াতে হলো।
সাদাপোশাকের তরুণ-তরুণীর ওই জমায়েত দেখে মনে জাগা কৌতূহলটা রাস্তার ওপারে নিয়ে গেল। দেখি তো, ঘটনা কী! দু–একজনকে জিজ্ঞেস করে কোনো পাত্তাই পেলাম না। সবাই এমন হইচই করছে আর কলকল করে কথা বলছে যে আমার কৌতূহল মেটানোর সময় কারও নেই। গলায় ঝোলানো অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেখে সাংবাদিক বুঝতে পারাতেই হয়তো দুই তরুণের একটু ‘দয়া’ হলো। হড়বড় করে বলা তাঁদের কথা থেকে যা জানলাম, এটা ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোতে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ এক উৎসব। কী হবে সেই উৎসবে? ‘আমরা পার্টি করব। অনেক রাত পর্যন্ত সবাই আনন্দ করব।’
নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শ বছর পূর্তি হয়েছে এ বছরই। সপ্তাহব্যাপী সেটির উদ্যাপনের শেষ দিন না আজ! এটি কি তাহলে তারই কোনো অংশ? ওই দুই তরুণের একজন জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় শতম জন্মদিনের সঙ্গে এটির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সাংবাৎসরিক আয়োজন। আমার মতো করে আমি বুঝে নিলাম, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নবীনবরণেরই আরেকটি ভিন্ন রূপ এটি। পার্থক্য বলতে আজকের রাতে নিজেদের বরণ করে নেওয়ার কাজটা নবীনেরা নিজেরাই করছে। কিন্তু এই পোশাকের রহস্য কী? আমাকে যা মনে করিয়ে দিচ্ছে গ্রিসের প্রাচীন অলিম্পিকের কথা। সবার শরীরে জড়ানো লতানো গাছের ডালটার কারণেই কি আরও বেশি? প্রাচীন অলিম্পিকে বিজয়ীদের জলপাইগাছের ডাল দেওয়া হতো। যেটিতে নিহিত বার্তার কারণে ‘অলিভ ব্রাঞ্চ’ কথাটা সন্ধি প্রস্তাবের একটা টার্মই হয়ে গেছে।
পোশাকের রহস্য যতটুকু জানতে পারলাম, সেটি খুব মজার। চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে যদি ঠিক শুনে থাকি, নবীনদের এই উৎসবে বাগড়া দিতে অথবা সেটিকে আরও আনন্দময় করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ররা তাঁদের গায়ে ডিম ছুড়ে মারেন। ভালো পোশাক নষ্ট করার কী দরকার! এই সাদা কাপড়ের টুকরা ডিমে মাখামাখি হয়ে পরিত্যক্ত হওয়ার কপাল নিয়ে আসা শুধুই এক রাতের পোশাক।
এরপর আরও এক–দুজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ কথা বলতে শুরু করলেই চারপাশ থেকে চিৎকার শুরু হয়ে যায়। আর কিছু শোনা যায় না। আমি তাই সেই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে ভাবলাম, মোটামুটি তো জেনেছিই, বাকিটুকু ‘গুগল ভাই’-য়ের কাছ থেকেই জানা যাবে। একটু আশ্চর্যই হলাম, ইন্টারনেটে এ নিয়ে কিছুই পাওয়া গেল না। চাইলেই যেকোনো কিছু পাওয়া যায় বলে গুগল-নির্ভরতাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কিছু না পেলে সত্যি অবাক লাগে। মনে পড়ে যায় সেই পুরোনো কৌতুকটাও। পার্কে বেড়াতে যাওয়া মা বলছেন, ‘আমার চার বছরের ছেলেটা কোথায় গেল! ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ পাশ থেকে একজন বললেন, ‘গুগলে সার্চ দিন। পেয়ে যাবেন।’