নতুন রূপে পুরোনো আসর

গ্রাফিক্স: মনিরুল ইসলাম
গ্রাফিক্স: মনিরুল ইসলাম

দুয়ারে কড়া নাড়ছে আরেকটি বিশ্বকাপ। আইসিসির কর্তারা অবশ্য ‘বিশ্বকাপ’ বললেই সংশোধনী দিয়ে দেন, ‘আইসিসির ওয়ার্ল্ড কাপ একটাই। এটির নাম ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি’।

কথাটা সত্যি। তবে এটাও সত্যি যে, ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি আমাদের মুখে মুখে ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ’ই হয়ে গেছে। তা এশিয়া কাপ নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা আসছে কেন? আসছে, কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে এই এশিয়া কাপেও। স্বমহিমায় উজ্জ্বল একটি টুর্নামেন্টের বদলে যেটি আসলে রূপ নিয়েছে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি টুর্নামেন্টে।
তাতে কিছু সমস্যাও হচ্ছে। এই টুর্নামেন্টের অতীত ইতিহাস টানতে গেলেই বর্তমানে এসে তা হোঁচট খাচ্ছে। এত দিন যে এশিয়া কাপ ছিল মহাদেশীয় ওয়ানডে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণী আসর, সেটি এবার টি-টোয়েন্টির মেলা। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি মেলাতে গেলে হোঁচট তো খেতেই হবে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে বলে এবার টি-টোয়েন্টি হচ্ছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ সামনে থাকলে এশিয়া কাপ হয়ে যাবে ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট। সমস্যাটা বেশি হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই। এশিয়ার অন্য তিন পরাশক্তির বেলায় ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি এমন কোনো আকাশ-পাতাল পার্থক্যের নাম নয়। ওরা ওয়ানডেতে যতটা ভালো বা খারাপ, প্রায় ততটাই টি-টোয়েন্টিতে। যেখানে সবচেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় সাগরে হাত-পা ছোড়ার অসহায়ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
একবার ভেবে দেখুন না, এই এশিয়া কাপও যদি ওয়ানডে হতো, কার সাধ্য ছিল বাংলাদেশকে ফেবারিটের তালিকা থেকে বাদ দেয়! এশিয়ার যে তিন পরাশক্তির কথা বলা হলো, সেই তিনটিই ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য যেখানে গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা। তাতে কী, ভারত-পাকিস্তান দু্ই দলের বিপক্ষেই সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে জয়ী দলের নাম তো বাংলাদেশ। বাদ শুধু শ্রীলঙ্কা। তা ২০১৫ সালে দেশের মাটিতে মাশরাফির দলের যে স্বপ্নযাত্রা, তাতে শ্রীলঙ্কা এলে তাদেরও হয়তো একই পরিণতি হতো। কিন্তু এই এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির আসর বলেই গত বছরের সুখস্মৃতির বদলে মনে উল্টো উঁকি দিচ্ছে দুঃস্বপ্নের এক স্মৃতি। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হংকংয়ের কাছে সেই পরাজয়!
এশিয়া কাপের সর্বশেষ আসরেও কিন্তু এমনই একটা দুঃখ ভারাক্রান্ত স্মৃতি আছে। খেলায় একের দুঃখ মানেই অন্যের উৎসব। ফতুল্লায় বাংলাদেশের দুঃখরাতে রচিত হয়েছিল আফগান-রূপকথার উজ্জ্বলতম অধ্যায়। কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে আফগানিস্তানের প্রথম জয়।
স্মৃতি বোধ হয় তার মতো করে সব সাজিয়ে নেয়। যে কারণে এশিয়া কাপ বললে ‘২০১৪’ ছাপিয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ‘২০১২’। যেটির শেষ মুশফিক-সাকিবদের কান্নায়। তবে সেই কান্নায় কি গৌরবও মিশে ছিল না! এশিয়া কাপে ‘বড় তিন ভাই’য়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদেরই ‘বড়’ হয়ে ওঠার সাক্ষী ওই এশিয়া কাপ।
দুই বছর পরপর হওয়ার কথা থাকলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির কারণে এশিয়া কাপ তা মেনে চলতে পেরেছে খুব কমই। দুটি এশিয়া কাপের মাঝে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরও বিরতি পড়েছে। ২০০৮ থেকে টানা পাঁচটি টুর্নামেন্ট যে দুই বছরের বিরতি মেনে চলছে, এটাকে তাই বিস্ময়করই বলতে হবে। এর চেয়েও বড় বিস্ময়, টানা তিনটি টুর্নামেন্ট ঢাকায় হয়ে এশিয়া কাপের একরকম বাংলাদেশের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে রূপ নেওয়া। দুই বছর পর পরের এশিয়া কাপও কি তাহলে ঢাকায়?
এই প্রশ্নটাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে এর চেয়েও জরুরি একটা প্রশ্ন—এশিয়া কাপ আর হবে তো? সংশয় জাগার কারণ আছে বৈকি! জগমোহন ডালমিয়ার মস্তিষ্কপ্রসূত এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) ফ্ল্যাগশিপ ছিল এই এশিয়া কাপ। ডালমিয়া আর নেই, এসিসিও এমন নামেমাত্র আছে যে, সেটিকেও মৃত বলেই ধরে নেওয়া যায়। শ্রীনিবাসনের অনেক ‘কীর্তি’র মধ্যে এটিও একটি। ক্রমশই ব্যস্ততর হয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির মাঝখানে সময় বের করে এশিয়া কাপ আয়োজনের চেষ্টাটা কে করবে, এটা একটা প্রশ্ন বটে। এত দিন ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে দেনদরবারের যে কাজটা এসিসিই করে এসেছে।
তারপরও যদি এশিয়া কাপ বেঁচে থাকে, সেটির সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র যে থাকবে না, সেটা তো বলেই দেওয়া হয়েছে। এশিয়া কাপ নাকি এখন থেকে শুধুই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি টুর্নামেন্ট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে বলে এবার টি-টোয়েন্টি হচ্ছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ সামনে থাকলে সেটি হয়ে যাবে ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট। মজাটা হচ্ছে, এশিয়া কাপের মাঝখানে দুই বছরের বিরতি থাকলে তো আগামীতে প্রতিবারই সেটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বছরই পড়বে। তার মানে কি এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতেই স্থায়ী রূপ পেয়ে গেল?
ক্রিকেট প্রশাসকদের হাতে খেলাটা এমনই খেলনা যে, এসব প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়ার আশা করাটাই বোকামি।