‘নতুন’ তাসকিন এখন পরিপূর্ণ এক ফাস্ট বোলার

বাংলাদেশের পেস আক্রমণের মুখ হয়ে উঠছেন তাসকিনফাইল ছবি: প্রথম আলো

১১ জুলাই, ২০২১। হারারে টেস্ট।

রানআপের একদম শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে তাসকিন আহমেদ। দৌড় শুরু করবেন করবেন, এই অবস্থায় একটা দুষ্টু হাসি খেলা করল মুখে। বাঁ হাতটা ভূমির সমান্তরালে এনে নাচের এক মুদ্রা দেখিয়েই ছুটলেন। ব্যাটসম্যান ব্লেসিং মুজারাবানির সঙ্গে দেনাপাওনা চুকাতে হবে না!

শুরুটা তাসকিনই করেছিলেন। নিজে ব্যাট করার সময় মুজারাবানি বাউন্সার দিয়েছিলেন। বলটা ছাড়ার পর এই আগ্রাসনকে যে পাত্তা দেন না, সেটা বোঝাতেই নাচের মুদ্রা দেখিয়েছিলেন। নিজে ফাস্ট বোলার, তাই ভালোমতোই জানেন, বাউন্সার দিতে যে বাড়তি শক্তিটা লাগে, সেটির এমন প্রতিক্রিয়া পেসারকে কতটা খেপিয়ে তুলতে পারে। বোলিংয়ের সময়ও তাই মুজারাবানিকে আবার খোঁচা দিলেন।

জিম্বাবুইয়ান পেসারও সেটা মনে রাখলেন। সুযোগমতো তাসকিনকে চার মেরেই সেটার জবাব দিলেন সেই মুদ্রা উপহার দিয়ে। একটু পর এনগারাভাও তাসকিনকে নেচে দেখালেন। খোঁচাখুঁচির শেষ হাসিটা তাই এক অর্থে জিম্বাবুয়ের পেসারদের।  

তাসকিন আহমেদ মানেই কেন যেন এমন কিছু দৃশ্যই মাথায় খেলা করে। সম্পূর্ণ আবেগনিয়ন্ত্রিত এক ক্রিকেটার, পরিণতি কী হবে—তা নিয়ে অতটা মাথা ঘামাতে রাজি নন।

তাসকিন
ছবি: এএফপি

এমন ভাবনায় খুব দোষ নেই। টিকটক, মাশরাফির সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে উদ্‌যাপন, প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভার পরও খামখেয়ালি আচরণ—তাসকিনের ব্যাপারে এমন একটা ধারণাই সৃষ্টি করেছে। এখনো মাঠে তাসকিনকে ছেলেমানুষি কোনো কাণ্ডের মূল চরিত্রে দেখার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু বল হাতের তাসকিন, সেটা পুরো অন্য এক গল্প।

বলে গতি শুরু থেকেই ছিল, কারিকুরি করার ক্ষমতাও, এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আগের চেয়ে অনেক পরিণত ক্রিকেট-মস্তিষ্ক। এসব মিলিয়ে তাসকিন হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বড় এক অস্ত্র। বাংলাদেশের উইকেটে মোস্তাফিজুরই হয়তো পেস বোলিংয়ের নেতা, তবে দেশের বাইরের গতিময় উইকেটে সেই স্বীকৃতিটা তাসকিনও পেতে পারেন। ক্রিকেট-মস্তিষ্ক যে পরিণত হয়েছে, ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝে সে অনুযায়ী বল করতে পারার ক্ষমতা যা তাঁর মধ্যে জন্মাচ্ছে; গত পরশু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আবারও দেখিয়েছেন তাসকিন।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জয়ের নায়ক সাকিব আল হাসান। ব্যাট করতে নেমে ম্যাচ পরিস্থিতি বদলে দেওয়া এক ইনিংস, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রাখে না। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক তামিম ইকবাল এসে মেহেদী হাসান মিরাজের নামও বললেন। প্রথম স্পেলে বেদম মার খেয়েও লড়াকু চরিত্রের প্রমাণ রেখে অধিনায়কের নজর কেড়েছেন এই অফ স্পিনার। স্মৃতিতে সর্বশেষ ঘটনাই তাজা থাকে, তাই মিরাজের কথাই বলেছেন তামিম। এ কারণেই হয়তো তাসকিনের নামটা বলা হয়নি তাঁর।

তাসকিন পরশু ছিলেন দুর্দান্ত
ছবি: এএফপি

৩১৫ রানের লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো ইনিংসেই ব্যাকফুটে ছিল। কদিন আগেই ভারতের বোলিং আক্রমণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এক ব্যাটিং লাইনআপের এমন হতশ্রী রূপটা তো তাসকিনই বের করে এনেছিলেন। পঞ্চম ওভারেই ডেকে আনা হলো তাঁকে। তৃতীয় বলেই পয়েন্ট দিয়ে চার মারলেন ভেরেইনা। মোস্তাফিজকে না এনে তাসকিনের হাতে বল দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল হলো কি? এ প্রশ্নের রেণু মনে উড়তে উড়তে শেষ হলো সে ওভার। পরের ওভারে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন তাসকিন। অফ স্টাম্পের বাইরে টানা বল করে গেলেন, বাভুমা অস্বস্তি নিয়ে পার করলেন ছয়টি বল।

বোলার তাসকিন যে আসলেই কতটা বদলেছেন, সেটা বোঝা গেছে পরের ওভারেই। আগের মেডেন ওভারে সবগুলো বল স্টাম্পের বাইরে ছিল বলে ব্যাটসম্যানের একটা মাইন্ডসেট তৈরি হয়ে গেছে। সে সুযোগটা প্রথম বলেই নিয়েছেন। স্টাম্পের একটু বাইরে পরে বল একটু নিচু হয়ে ভেতরে ঢুকল। আঘাত হানল প্যাডে, গতিতে পরাস্ত ভেরাইনা সময়মতো ব্যাটে বল ছোঁয়াতে পারলেন না। পরের দুই বল আবার স্টাম্পের বাইরে। চতুর্থ বলটা স্টাম্পের বাইরে ফুল লেংথে। ব্যাটসম্যানকে ড্রাইভ করার আহ্বান জানানো এক বল।

নব্বইয়ের দশকের ফাস্ট বোলারদের মধ্যে ঈর্ষণীয় স্ট্রাইকরেট ছিল ওয়াকার ইউনিসের। পাকিস্তানি পেসার বলেছিলেন, ব্যাটসম্যানদের ড্রাইভ করার আগ্রহ জাগানোতেই লুকিয়ে সব রহস্য। তাসকিনের এই বলটাও সেই নীতিরই বাস্তবায়ন। আক্রমণাত্মক এক ব্যাটসম্যানের পক্ষে এমন বলের লোভ সামলানো কঠিন। এত বাইরের বলে শট খেলায় পা ঠিকমতো গেল না, মাথাও ছিল না জায়গামতো। ফলাফল বল পয়েন্টের পেছনে উড়ে মিরাজের হাতে। নবম ওভারেই পথহারা দক্ষিণ আফ্রিকা।
৩৬ রানে ৩ উইকেট, এমন পারফরম্যান্সে তাসকিনের আড়ালে থাকা একটু হলেও বিস্ময় জাগায়। তাঁর যে আড়ালে থাকার অভ্যাস নেই!

আবির্ভাবেই চমক ছিল তাসকিনের। ২০১৪ সালে ঘরের মাঠের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেক। সব হারিয়ে ফেলা দুই দলের সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের চমকে দিয়েছিল তাসকিনের গতি। ৪ ওভারে ২৪ রান দিয়ে ১ উইকেট স্বপ্নের কোনো অভিষেকের কথা বলে না। কিন্তু সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের অভিব্যক্তি একটা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিল। দুই মাস পর যে ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকেই ৫ উইকেট, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম এমন কোনো কীর্তি।

তাসকিনকে ঘিরে স্বপ্ন দেখার শুরু সেদিন, যা ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। মাশরাফির সঙ্গে বিখ্যাত সেই উদ্‌যাপনেই শুধু নজর কাড়েননি, বল হাতেও ছিলেন দুর্দান্ত। প্রকৃতিদত্ত গতিকে সম্বল করেই তখন দুর্বার তাসকিন। ঘরের মাঠে পাকিস্তান ও ভারতকে হারানোর পর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পেস আক্রমণ বাংলাদেশের কি না, এই আলোচনাতেও তাসকিন প্রভাবক ছিলেন। ভারত সিরিজেই মোস্তাফিজের আবির্ভাবের পর দুজনের জুটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা হয়েছে। কিন্তু একদিকে মোস্তাফিজ যত এগিয়েছেন, ব্যস্তানুপাতে হারিয়েছেন তাসকিন।

দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে মোস্তাফিজকে যখন ক্রিকেটের বিরলতম বোলারদের একজন হিসেবে দেখা হয়, সেখানে তাসকিন জাতীয় দল থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের পর টানা ৩৪ মাস তাসকিনকে দর্শক হিসেবে বাংলাদেশের খেলা দেখতে হয়েছে। এতে দুর্ভাগ্যও ভূমিকা রেখেছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে তাঁর সুযোগ না পাওয়ায় নির্বাচকদের দূরদর্শিতার অভাব ভূমিকা রেখেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্ম ফিরে পেয়ে যখন ডাক পেয়েছেন, তারপরই চোটে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

গত এক বছর ধরেই ভিন্ন তাসকিনের দেখা মিলছে
ছবি: এএফপি

এভাবে বারবার পুড়তে পুড়তে তাসকিন নিজেকে গড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০২১ সালে জাতীয় দলে ফেরা তাসকিন তাই অন্য রকম। মাঠে এখনো প্রাণচঞ্চল, এখনো দলের উচ্ছ্বাসের প্রাণকেন্দ্রে থাকেন। মুজারাবানিদের নাচের মুদ্রায় খেপিয়ে তোলার ছেলেমানুষি এখনো দেখা যায়। পরিসংখ্যানও খুব একটা পার্থক্য করতে পারবে না। বরং বলবে আগের চেয়ে তাসকিনের স্ট্রাইকরেট খারাপ হয়েছে, গড়েও খুব বেশি তফাত নেই। অভিষেকের পর আর কখনো ৫ উইকেটের দেখা মেলেনি। সে তথ্যেও পরিবর্তন আসেনি।

কিন্তু ফাস্ট বোলিংকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে যাওয়ার মতো বোকামি আর নেই। এর প্রভাব দেখতে হয়, গতিতে ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেওয়ায়, বলের মুভমেন্টে অস্বস্তিতে ফেলায়, ড্রেসিংরুম, প্রেসবক্স আর গ্যালারিতে ‘এই বুঝি কিছু হলো’—এই চাপা উত্তেজনায়। শুরুর তাসকিনেও এটা ছিল, এখন তাতে মাথা খাটানোও যোগ হতে দেখা যাচ্ছে। তাসকিন এখন তাই পরিপূর্ণ এক ফাস্ট বোলার, মাঠ-উইকেট-কন্ডিশন; সবকিছু পাশে রেখে যাঁকে নিয়ে ভাবতে হয় প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে।

ধূমকেতুর মতো হারিয়ে যেতে যেতেও ফিরে এসেছেন তাসকিন, এবার তাঁর আকাশে থিতু হওয়ার পালা।