ধুল ছুঁলেই সোনা হয়ে যাচ্ছে সব
‘যা ছোঁবেন, তা সঙ্গে সঙ্গেই সোনা হয়ে যাবে’—কথাটা শুনলে উঁকি দেন এক রাজা।
ফ্রিজিয়ার রাজা মাইডাস। গ্রিক পুরাণে আছে, দেবতা ডায়োনিসাস তাঁকে সোনালি স্পর্শের বর দিয়েছিলেন। সুদূর গ্রিসে না গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ সিনেমাও দেখে নিতে পারেন। এক সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত কেরানি পরশপাথরের দেখা পাওয়ার পর তাঁর জীবন কীভাবে পাল্টে গেল, তার অসাধারণ চিত্রায়ণ।
রুপালি পর্দায় তা দেখার সময় মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আচ্ছা এই জগতে কি সত্যিই পরশপাথর বলে কিছু আছে, যার সংস্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে যায়!
আছে। কিন্তু তা কোনো পাথর না, দেবতার বর না, এমনকি চোখেও দেখা যায় না। ছুঁয়ে দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু অনুভব করা সম্ভব। যেমন ধরুন—পরিশ্রম, মেধা, একাগ্রতা...নিবেদনের মতো বিষয়গুলোর সংমিশ্রণে মানুষ পরশপাথর হয়ে ওঠে। চাইলে এমন মানুষের উদাহরণও দেওয়া যায়—যশ ধুল।
নামের শেষে বিস্ময়বোধক চিহ্নটা সচেতনভাবেই রাখা হয়নি। ছেলেটার বয়স ১৯ বছর ১০১ দিন। সামনে অনেক পথ, আরও অনেক বড় বড় কীর্তি ডাকছে তাঁকে। আপাতত এই তরুণ আজ যা করলেন, তাতে নাম লিখিয়েছেন ক্রিকেট–অমরত্বের এক পাতায়।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে দুই ইনিংসে শতক! রঞ্জিতে দিল্লি–তামিলনাড়ু চার দিনের ম্যাচে দিল্লির প্রথম ইনিংসে ১১৩ রান করে নাম লেখান শচীন টেন্ডুলকার, রোহিত শর্মার পাশে। সেটি ছিল রঞ্জিতে অভিষেকে শতকের রেকর্ড। ধুল আজ ছাপিয়ে গেছেন টেন্ডুলকার–রোহিতদেরও।
দিল্লি ৪৫২ রানে প্রথম ইনিংস ঘোষণার পর ৪৯৪ রানে নিজেদের প্রথম ইনিংসে অলআউট তামিলনাড়ু। আজ শেষ দিনে দিল্লির দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৩ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন ধুল। রঞ্জির ইতিহাসে তৃতীয় এবং সব মিলিয়ে নবম ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির অভিষেকে দুই ইনিংসেই শতক তুলে নেওয়ার রেকর্ডে নাম লেখালেন।
সেই নাম লেখার ‘কালি’ও অনন্য—দুই ইনিংসেই ১১৩! অভিষেকে দুই ইনিংসেই একই স্কোরের দেখা পাননি আর কেউ।
ফেব্রুয়ারিতে ধুলের ‘মাইডাস’ হয়ে ওঠার শুরু ২ তারিখ থেকে। সেদিন অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১০ রানের হিরণ্ময় এক ইনিংস খেলেন। মাঝে দুই দিন পর অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জেতান ভারতকে। অধিনায়ক হিসেবে।
এরপর ভালোবাসা দিবসের আগের দিন ডাক আসে আইপিএল থেকে। হ্যাঁ, একরকম ‘প্রেমে’র প্রস্তাবই বটে! মেগা নিলামে ধুলকে কিনে নেয় দিল্লি ক্যাপিটালস। তিন দিন পর রঞ্জিতে অভিষেকে শতক এবং তারপর আজ পেলেন জোড়ার দেখা। ধুল মাইডাসের চেয়ে কোনো অংশে কম!
বরং বেশি। জনশ্রুতি আছে, পুরাণের মাইডাস সোনালি স্পর্শের অপব্যবহারে মারা গিয়েছিলেন অনাহারে। ধুলের পথটা আলাদা। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ‘ভবিষ্যৎ’ হিসেবে দেখা হলেও তাঁর পা মাটিতেই রাখার ব্যবস্থা করেছে দেশটির ক্রিকেট। নিলামে তাঁর ভিত্তিমূল্য ছিল ২০ রাখ রুপি। দিল্লি তাঁকে কিনেছে ৫০ লাখ রুপিতে।
গা থেকে কৈশোরের গন্ধ যাই যাই করার আগেই তাঁকে কোটিপতি বানিয়ে বখে যেতে দেয়নি ভারতীয় ক্রিকেট। এর পেছনে অবশ্য ধুলের পরিণত চিন্তার ছাপও আছে। তারকা হয়ে উঠছেন বোঝার পরও, নিলামে নিজের দামটা ‘বিনয়ী’ মাপকাঠিতে রাখেন ধুল।
কেন? ঠিকঠাক করে বলা মুশকিল। তবে ধুলের উঠে আসার পথে তাকালে একটি বিষয় আন্দাজ করে নেওয়া যায়। অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে কোভিড–১৯ পজিটিভ হন। ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও আইসোলেশনে থাকতে নিজ কামরায় ব্যাট নিয়ে ‘শ্যাডো’ অনুশীলন করে গেছেন, ম্যাচে নামলে কীভাবে ব্যাট করতেন সেভাবে।
গ্রুপ পর্বে আর ম্যাচ খেলতে পারেননি। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৬ বলে ২০ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই শতক—পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে তুলে নেয় চকচকে সব সোনালি সংখ্যা!
দিল্লির পশ্চিমাঞ্চল থেকে উঠে আসা ক্রিকেটাররা মানসিক দৃঢ়তার জন্য আলাদা করে খ্যাতিমান ভারতীয় ক্রিকেটে। বিরাট কোহলি যদি হন এর আদর্শ উদাহরণ, ধুল তাহলে ফুটতে থাকা কুঁড়ি।
দিল্লিতে তাঁকে ১০ বছর কোচিং করানো রাজেশ নাগর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘(অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপে যেসব ম্যাচ খেলতে পারেননি) সে দিনে দুই ঘণ্টা করে শ্যাডো ব্যাটিং করত। টিভিতে ম্যাচ দেখত। ম্যাচের পরিস্থিতিতে নিজেকে ভেবে অনুশীলন করত। সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য দাদার কাছ থেকে মানসিক দৃঢ়তা পেয়েছে।’
কোহলির মতো ধুলও বোলারের পাশের দুই দিক ‘ভি’–তে খেলতে পছন্দ করেন। কবজিও নমনীয়, চাপের মুহূর্তে স্ট্রাইক অদল–বদলে মুনশিয়ানার ছাপ আছে। কোহলির মতোই পারতপক্ষে সুইপ খেলেন না। ব্রাজিলিয়ান ‘জোগো বোনিতো’য় যেমন হেডে গোল করা একটু খাটো চোখে দেখা হয়, তেমনি ধ্রুপদি ব্যাটিংয়ের ধারাপাতেও যে সুইপের জায়গা খুব কম, তা আন্দাজ করে নেওয়া যায়।
নাগর জানালেন, ধুল ১০ বছর বয়সে থাকতে তাঁকে যদি বেলা ৩টায় অনুশীলনে আসতে বলা হতো, দেখা যেত বেলা ১টায় এসে নিজেই অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে। সেই নিবেদনটুকু এই ফেব্রুয়ারিতে ‘মাইডাস টাচ’ পাওয়ার অন্যতম ভিত্তি।
ভিত্তি আরও আছে। যশের বাবা একটি কসমেটিকস কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দাদার পেনশনে চলত সংসার আর বাবার আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে তাঁর ক্রিকেটার হয়ে ওঠায়।
কিছুদিন আগে তাঁর বাবা এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘সে ছোটবেলা থেকেই যেন খেলাধুলার সেরা সরঞ্জাম পায়, তা নিশ্চিত করেছি। সেরা ইংলিশ উইলো (ব্যাট) এনে দিয়েছি। এ জন্য নিজেদের সাংসারিক খরচ ছাঁটতে হয়েছে।’ পরিবারের এই ত্যাগটুকু যশকে এখনই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়নি—বলা ভালো, উড়াল দেওয়ার আগে রঞ্জির জমিনে শক্ত ‘রানওয়ে’টুকু পেয়ে গেলেন যশ। তবে সেই রানওয়েতে তাঁর পূর্বসূরিদের নামগুলো দেখলে বোঝা যায়, এই ছেলে লম্বা রেসের ঘোড়া।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে যে নয়জন দুই ইনিংসেই শতক পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন হলেন আর্থার মরিস ও নরি কন্ট্রাক্টর। প্রথমজন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ‘ইনভিন্সিবলস’ দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের প্রিয় ওপেনার, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা বাঁহাতি এবং ব্র্যাডম্যানের কারণেই বিস্মৃত হয়েছে তাঁর একটি ইনিংস।
১৯৪৮, ওভাল টেস্ট—শেষ টেস্টে বিখ্যাত শূন্য ব্র্যাডম্যানের। ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্ব পাওয়া এই শূন্যের কারণে অস্ট্রেলিয়ার সে ইনিংসে মরিসের ১৯৬ ভুলে গেছেন অনেকেই।
মরিস ১৯৪০ সালে সিডনিতে অভিষেকে জোড়া শতক তুলে নেওয়ার এক যুগ পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর এই কীর্তিতে ভাগ বসান নরি কন্ট্রাক্টর। ক্যারিবিয়ান ভয়ংকর পেসার চার্লি গ্রিফিথের বলে মাথায় বাজে আঘাত না পেলে ভারতীয় কিংবদন্তির ক্যারিয়ার ‘অতি অল্পে’ শেষ হতো না। রঞ্জিতে ধুলের আগে যে দুজন একই কীর্তি গড়েছেন, ভিরাজ আওয়াতে (২০১২) দ্বিতীয় এবং ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কন্ট্রাক্টর’ প্রথম।
তবে সব মিলিয়ে তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে মরিস ও কন্ট্রাক্টরের পর একই মাইলফলক গড়া ব্যাটসম্যানও উপমহাদেশের। পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলা আমির মালিক। উপমহাদেশ থেকে আরও আছেন শ্রীলঙ্কার কে এইচ টি ইন্ডিকা ও পাকিস্তানের হাজি মুরাদ। তাঁদের কারও ক্যারিয়ারই দীর্ঘ হয়নি। হাজি মুরাদ ও আওয়াতের তো জাতীয় দলেই সুযোগ হয়নি।
ধুলের পথটা আপাতত সোনায় মোড়ানো। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।