২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তোতলামো থেকে ধারাভাষ্যে ৫১ বছর

সেন্ট লুসিয়ার প্রেসবক্সে জোসেফ ‘রেডস’ পেরেইরাছবি: প্রথম আলো

‘ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে আমি জোসেফ “রেডস” পেরেইরা বলছি...।’ ভরাট, মধুর, স্পষ্ট উচ্চারণ। একটু পরপরই তাঁর ফোন বেজে উঠছে। প্রেসবক্সে বসে চোখের সামনে যে খেলাটা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক পেছন থেকে পেরেইরার কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছি সেটারই বর্ণনা।

ভদ্রলোকের নামটা তো জেনেই গেছেন—জোসেফ ‘রেডস’ পেরেইরা। ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যাঁরা রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনে থাকেন, তাঁদের কাছে অতিপরিচিত এক নাম; পরিচিত পেরেইরার ভরাট কণ্ঠটাও।

পেরেইরা সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আগে তাঁর নামের ‘রেডস’ অংশটার ব্যাখ্যা দিয়ে নেই। তরুণ বয়সে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি— সবই খেলতেন। তখন তাঁর চুলের রঙ ছিল লাল। সেটা থেকেই পত্র–পত্রিকায় নামটা সংক্ষেপে লেখা হতো ‘রেডস’, যেটা আজও জুড়ে আছে পেরেইরার নামের সঙ্গে।

৮৩ বছর বয়সী পেরেইরা গত বছরই পূর্ণ করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ধারাভাষ্যে তাঁর ৫০তম বছর। ৫০ বছরের অর্জনের কথা বলতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠে গর্ব, ‘১৫২টি টেস্ট ম্যাচ এবং তিন শর বেশি ওয়ানডেতে ধারাভাষ্য দিয়েছি। বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিয়েছি পাঁচবার। ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ২০০৩ ও ২০০৭ সালে। আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি ১৯৭৫–এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ধারাভাষ্য দেওয়া।’

পেরেইরার থাকার কথা ছিল পরের বিশ্বকাপের ফাইনালেও। কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে একজন বাড়তি ধারাভাষ্যকার চলে আসায় তাঁকে সরে যেতে হয়।’ ধারাভাষ্যকার হিসেবে পেরেইরার ১৫০তম টেস্ট ছিল ২০১৯ সালে জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে অনুষ্ঠিত ভারত–ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি।

আমি টনিকে সাহস দিয়ে বলেছিলাম, “তুমি ফিরে আসবে।” কিন্তু আর তো এল না! ওর চলে যাওয়া আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমি সেদিন বাচ্চাদের মতো কেঁদেছি।
প্রিয় বন্ধু টনি কোজিয়ারের মৃত্যুর সময়ের স্মৃতি ভুলতে পারেন না জোসেফ পেরেইরা

ধারাভাষ্য দিতে পেরেইরা অনেক দেশই ঘুরেছেন। তার মধ্যেও অপূর্ণতা, ‘ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে আমি শুধু বাংলাদেশেই যাইনি।’ বাংলাদেশে না গেলেও বাংলাদেশের ইতিহাস তাঁর মোটামুটি জানা। ১৯৬১ সালে গায়ানা এবং ত্রিনিদাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ দিয়ে ধারাভাষ্যে অভিষেক, কিন্তু পেরেইরা টেস্টে প্রথম ধারাভাষ্য দেন ১৯৭১ সালে গায়ানায় ভারত–ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে।

‘সেই বছরটা বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়’ বলতেই মুখের কথা কেড়ে নিলেন, ‘আমি জানি...সে সময় বিবিসি রেডিওতে শুনেছিলাম, পাকিস্তান ভাগ হয়ে অন্য দেশ হয়েছে। কয়েক বছর পর তোমাদের একজন কিংবদন্তি নেতাকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) হত্যা করা হয়, সেটাও শুনেছি।’

প্রসঙ্গক্রমে তাঁর মনে পড়ে যায় ইন্দিরা গান্ধী হত্যার ঘটনাও, ‘তুমি জানো, ওই ঘটনার কয়েক দিন আগেই আমি ভারতে গিয়েছিলাম ধারাভাষ্য দিতে। একটা ম্যাচে ইন্দিরা গান্ধী মাঠে এসেছিলেন, আমরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। পরে তো শুনেছি, ওনাকে মেরে মেলেছে।’

পেরেইরা এখন আর খেলার ধারাবর্ণনা দেন না। তবু ক্যারিবীয় বেতারে তিনিই ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর। তাঁর ভরাট কণ্ঠে ক্রিকেট শোনা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছেন না ভক্ত–শ্রোতারা। এই বয়সেও পেরেইরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে ম্যাচের লাইভ রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন। প্রেসবক্সে বসে নোট নিচ্ছেন, সেই সকালে এসে থাকছেন দিনের শেষ বল হওয়া পর্যন্ত।

মোবাইলের মাধ্যমে ‘লাইভ’ চলছে তাঁর
ছবি: প্রথম আলো

ক্যারি প্যাকার সিরিজ কাভার করা পেরে্ইরার সাংবাদিকতা–জীবনেও আছে বড় অর্জন। ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘রেবেল ট্যুর’–এর খবরটা তিনিই প্রথম ফাঁস করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ, তখনো খেলা কাভার করেছেন সেই দেশে গিয়ে। সাংবাদিক–ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাভার করেছেন অনেক ঐতিহাসিক ক্রিকেট ম্যাচ। সেই সব ম্যাচের প্রতিটি মুহুর্ত এখনো যেন তাঁর কাছে জীবন্ত।

জোসেফ পেরেইরা কাজ করেছেন ক্রীড়া প্রশাসনেও। অর্গানাইজেশন অব ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান স্টেটস স্পোর্টস ডেস্কের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন, অলংকৃত করেছেন সেন্ট লুসিয়া বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের পদও। তবে গায়ানায় জন্ম নেওয়া পেরেইরা নিজেকে সবার আগে একজন ধারাভাষ্যকারই ভাবেন, ক্রিকেটের সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক কখনোই চুকোনোর নয়।

শুক্রবার সেন্ট লুসিয়া টেস্টের প্রথম দিন ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের প্রেসবক্সে প্রবীণ এই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর খেলা দেখতে দেখতে প্রায় সারা দিনই গল্প হলো। সেন্ট লুসিয়ায় অনেক বছর ধরে থাকলেও আসলে তিনি গায়ানার মানুষ। সে জন্যই সিরিজের শেষ অংশে গায়ানায় যাব শুনে খুশি হলেন খুব। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পরিচিত একজনকে ফোন দিলেন আমাদের হোটেলের ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখতে।

তারপর কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা তোমাদের দলের সঙ্গে চলাচল করতে পারো না? ওদের তো অনেক বড় বাস। ওটার পেছনে বসেই তো মাঠ–হোটেল করতে পারো।’

কথাটা বলে নিজেই সম্ভবত বুঝতে পারলেন সাংবাদিকদের টিম বাসে চড়াটা এই যুগের ক্রিকেটের সঙ্গে যায় না, ‘আসলে এখন তো নিরাপত্তারক্ষীদের পেরিয়ে টিম হোটেলে ঢোকাই কঠিন। কোভিড সবকিছু আরও জটিল করে দিয়েছে। আমাদের সময় ক্রিকেটাররাই আমাদের ওদের বাসে তুলে নিত।’

যে শব্দগুলো আমি ঠিকভাবে বলতে পারতাম না, সেগুলো জোরে জোরে বারবার উচ্চারণ করতে থাকতাম, যতক্ষণ না সেটা ঠিকভাবে বলতে পারতাম। প্রতিদিন এটা করতাম।
ছোটবেলায় তোতলামোর সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন, বর্ণনায় জোসেফ পেরেইরা

সেই ক্রিকেটারদের অনেকেই এখনো তাঁর বন্ধু। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের নামটাই আগে বললেন, এরপর বন্ধুদের তালিকাটা লম্বা হতে লাগল আরও। ক্লাইভ লয়েড, স্যার গারফিল্ড সোবার্স, রিচি রিচার্ডসন, ডেসমন্ড হেইন্স, গর্ডন গ্রিনিজ, কোর্টনি ওয়ালশ— কে নেই সেখানে! শেষ নামটা বলে পেরেইরা একটু হাসলেন, ‘ওয়ালশের সঙ্গে যোগাযোগটা কম। ও সহজে ই–মেইলের জবাব দেয় না। নইলে সবার সঙ্গেই কথা হয়, বার্তা বিনিময় হয়।’

সবচেয়ে কাছের বন্ধু কে, জানতে চাইলে অবশ্য তিনি এঁদের কারও নামই বলেননি। বললেন এমন একজনের নাম, যিনি আর এই ধরাধামেই নেই—টনি কোজিয়ার। চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে পেরেইরা একটু আবেগপ্রবণই হয়ে পড়লেন, ‘ও যখন হাসপাতালে যাচ্ছিল, আমাকে তখন ফোন করেছিল। স্ত্রী জিলিয়ানকে বলেছে, “ওকে (পেরেইরা) একবার ফোন করো। ওর সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।” জিলিয়ান ফোন করলে আমি টনিকে সাহস দিয়ে বলেছিলাম, “তুমি ফিরে আসবে।” কিন্তু আর তো এল না! ওর চলে যাওয়া আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমি সেদিন বাচ্চাদের মতো কেঁদেছি।’

ধারাভাষ্যে কোজিয়ারকে একরকম গুরু মানা পেরেইরার ছোটবেলা থেকেই ধারাভাষ্য শোনার নেশা ছিল। ক্রিকেট ধারাভাষ্যে তখন যাঁরা কিংবদন্তি সেই রয় লরেন্স, টনি উইলিয়ামস, ফ্রেডি ট্রুম্যান, ব্রায়ান জনস্টন, রিচি বেনো, জেরি রিচার্ডসদের ধারাভাষ্য তাঁকে খুব টানত। নিজে ধারাভাষ্যকার হওয়ার পর ধারাভাষ্য দিয়েছেন তাঁদেরই অনেকের সঙ্গে বসে। অথচ তাঁর ছোটবেলায় এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিনই ছিল যে, পেরেইরা ক্যারিয়ার গড়বেন ধারাভাষ্যে। তিনি নিজেও কখনো কল্পনা করেননি এটিই হবে তাঁর পেশা।

ধারাভাষ্যকার হওয়ার পথে তাঁর সবচেয়ে বড় বাধা যে ছিল কথা বলাতেই! ছোটবেলা থেকে তিনি ঠিকভাবে কথা বলতে পারতেন না, তোতলাতেন। এ নিয়ে এমন বিব্রত থাকতেন যে, স্কুলে বন্ধুদের, আত্মীয়স্বজনদের এড়িয়ে চলতেন। দোকানে গিয়ে বলতে পারতেন না, ‘আমাকে অমুক জিনিসটা দিন।’

বিশেষ করে ইংরেজি ‘আর’ এবং ‘এস’–এর উচ্চারণ নাকি তাঁর হতোই না। ধারাভাষ্যকার হতে কীভাবে সে চ্যালেঞ্জটা জিতেছিলেন, তা জানাতে গিয়ে আরেকবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন পেরেইরা। গল্পটা যে তাঁর মাকে নিয়ে!

৮৩ বছর বয়সেও নিয়মিত ক্রিকেট কাভার করেন পেরেইরা
ছবি: প্রথম আলো

শৈশবের কষ্টের দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে পেরেইরা বলছিলেন, ‘রাতের বেলা মায়ের পাশে শুয়ে আমি কল্পিত ধারাভাষ্য দিতাম। কল্পনা করতাম আমি ধারাভাষ্যকক্ষে বসে আছি, আমার সামনে খেলা চলছে। অমুক এখন বোলিং করবেন, ফিল্ডিংয়ে অমুক জায়গায় তমুক আছেন। ব্যাটসম্যান বলটাকে কাভারে ঠেলে দিয়ে ১ রান নিল। ফিল্ডিং পজিশনে আবার রদবদল...এভাবে রাতের পর রাত আমি বলতেই থাকতাম। পাশ থেকে মা কখনো বলেননি, “এই, থাম্।” উল্টো উৎসাহ দিতেন যেন আমি বেশি বেশি কথা বলে তোতলামোটা কাটিয়ে উঠতে পারি।’

কাল্পনিক ধারাভাষ্য ক্রমেই আত্মবিশ্বাসী করে তোলে পেরেইরাকে। তবে কথা বলার সমস্যা সারাতে সবচেয়ে কাজে দিয়েছে টিনএজ বয়সে তিনি যখন থালাবাসন ধোয়ার কাজ নিয়ে বছরখানেকের জন্য ডেনমার্কে গেলেন, সেই সময়টা।

সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত কাজ থাকত না। কোনো ডাক্তারের সাহায্য না নিয়ে ওই সময়টায় তিনি নিজের চিকিৎসা নিজেই করেছেন স্ব–উদ্ভাবিত পন্থায়, ‘যে শব্দগুলো আমি ঠিকভাবে বলতে পারতাম না, সেগুলো জোরে জোরে বারবার উচ্চারণ করতে থাকতাম, যতক্ষণ না সেটা ঠিকভাবে বলতে পারতাম। প্রতিদিন এটা করতাম। এভাবে একটু একটু করে আমি কথা বলার সমস্যা কাটিয়ে উঠি এবং আত্মবিশ্বাসী হই। বলতে পারো, এই আত্মবিশ্বাসই পরে আমার ধারাভাষ্যকার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমি কখনো হাল ছেড়ে দিইনি।’

কথাটা বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠল পেরেইরার। রিসিভ বাটনে চাপ দিলেন, ফোন কানে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে আমি জোসেফ “রেডস” পেরেইরা বলছি। দিনের খেলা শেষ হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। তবে আলো কমে আসছে। আমার মনে হয় না, অতটা সময় খেলা হবে...।’

না, কথাগুলো বলার সময় জোসেফ ‘রেডস’ পেরেইরা একটুও তোতলাননি।