আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাসআক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এইসময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলেদিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো-
দিনের রুটিনটাই আগে বলি। সেহরি খেয়ে ফজরের নাম শেষে ঘুমিয়ে উঠি বেলা ১২টার দিকে। এই সময় আমার মেয়ে আরিবাও ঘুম থেকে উঠে যায়। ওর হাত-মুখ ধুইয়ে দিই। বিকেলে আসরের নামাজের পর ছাদে ক্রিকেট খেলতে যাই। ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের ছেলেরাও যোগ হয়। সব মিলিয়ে ৯জন ক্রিকেট খেলি। খেলা শেষে সবাই একসঙ্গে ইফতারি সারি। রাতে তারাবির নামাজ আদায়, টিভি দেখা, লুডু খেলা—এভাবেই কেটে যাচ্ছে এক একটা দিন।
করোনায় সব কিছু অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এটা আমার কাছে খুব একটা খারাপ লাগছে না! কেন? বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচথেকেই আমি দলের সঙ্গে ছিলাম লম্বা সময়। ১৩ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছি। মাঝে তিন বছর নিষিদ্ধ ছিলাম। ওই সময়ে আসলে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অভিজ্ঞতাটা হয়েছে। কীভাবে একা থাকতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ায় এখন আর সমস্যা হচ্ছে না। খারাপও লাগে না। আমি এখন অনায়াসে মানিয়ে নিতে পারি।
আমার কাছে নিষিদ্ধ থাকার সময়টা এখনকার চেয়ে অনেক অনেক কঠিন ছিল। এখন সাকিব কী বলে? খেলতে পারলেই সে খুশি। কারণ, ও চাইলেও এখন খেলতে পারছে না। একই পরিস্থিতি আমারও হয়েছিল। মন ভীষণ চাইছে, অথচ খেলতে পারছি না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক খেলা খেলেছি। কিন্তু ওসব ম্যাচ খেলে খুব একটা মজা পেতাম না। যেহেতু শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছি। করোনার চেয়ে আমার কাছে ওই সময়টাই বেশি কঠিন ছিল।
জানেন, তখন তো আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি! আমিও তো মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিলাম। মানুষের কাছে কীভাবে মুখ দেখাব, আমার পরিবার কতটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেল, এসব ভেবে অনেক নেতিবাচক চিন্তা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। আমার দুলাভাই অনেক বুঝিয়েছেন, 'আজহারউদ্দিন এত কিছু করে পরে সাংসদ হয়ে গেল! আর তুই এসব কী ভাবছিস? একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আর তুই তো সব স্বীকার করে ফেলেছিস। তোর হারানোর কিছু নেই।' তবুও নেতিবাচক চিন্তা মাথায় এসেছে। করোনায় অন্তত আত্মহত্যার কথা মাথায় আসবে না।এখন চিন্তাটা শুধু স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিয়ে।
হ্যাঁ, খারাপ লাগছে, ক্রিকেট খেলতে পারছি না। প্রিমিয়ার লিগটা বন্ধ হয়ে আছে। তবে যেটা বললাম, করোনার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাটা খারাপ লাগছে না। আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে শিখেছি। এ প্রসঙ্গে করোনায় আক্রান্ত আশিক ভাইয়ের (আশিকুর রহমান) সঙ্গে আমার একটা স্মৃতি মনে পড়ছে।
তিনি আমার বয়সে একটু বড় হলেও আমরা বন্ধুর মতোই মিশেছি। ধানমন্ডি মাঠে ওয়াহিদ স্যারের কাছে অনুশীলন শেষে হেঁটে হেঁটে আশিক ভাই আর আমি আসতাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। অনুশীলনের পর স্বাভাবিকভাবেই খুদা লাগে। তখন আশিক ভাই খুঁজতেন ডাবের পানি, যাতে শক্তি পাওয়া যায়। আর আমি ডাবের শাঁস। শক্তি পরে, আগে বেঁচে নিই। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা আমার এভাবেই গড়ে উঠেছে।
এখন যে পরিস্থিতি, পেশা নিয়ে চিন্তা করার সময় নয় এটা। কীভাবে নিরাপদ থেকে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যায়, সে চিন্তাই সবাই করছি। সব ঠিক হলে তখন হয়তো নির্ভয়ে আবার কাজ শুরু করা যাবে। সাড়ে ১৬ বছর বয়সে বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। কীভাবে কষ্ট করে টিকে থাকতে হয়, সেটা বেশ জানা। আরেকজনের কষ্টও বেশ অনুভব করতে পারি। এই পরিস্থিতিতে তাই খেলা নিয়ে কোনো চিন্তাই করছি না। সবাই যদি সুস্থ থাকি, ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আরও খেলা যাবে।
আশিক ভাইয়ের কথা বলছিলাম, ওনার প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ কর। এ করোনার মধ্যেই আমার সঙ্গে একদিন তিনি রসিকতা করছিলেন, 'চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, টাইফয়েড—যে রোগ আসে, সেটাই আমাকে ধরে!' আমি তখন মজা করে বলছিলাম, 'আপনার তাহলে করোনাও ধরতে পারে!' তিনি আপত্তি জানিয়ে বলেন, 'আরে ধুর! কী বলো?' আমি অবশ্য অভয় দিয়ে বলেছি, 'যদি করোনা ধরেও আপনাকে, ইনশাআল্লাহ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।'
সত্যি সত্যি করোনায় আক্রান্ত হলেন আশিক ভাই। এখন অবশ্য খারাপ লাগছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।