ডন, মাস্টার, লিটল মাস্টার, ম্যাড ম্যাক্স...মুশফিক
দেশের হয়ে প্রথম কিছু করতে পারার আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে? সম্ভবত না। প্রথম এভারেস্ট জয়, প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পারি দেওয়া কিংবা বিশ্বভ্রমণই ধরুন, বাংলাদেশের হয়ে এমন কিছু করতে পারার গর্বে যে কারও বুক চওড়া হয়ে উঠবে।
মুশফিকুর রহিম গড়নে বেশ ছোটখাটো, কিন্তু এই ছোটখাটো গড়নের ভেতরে অমিত ধৈর্য, জেদ ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে যে ‘অতিমানব’ লুকিয়ে, তা কিন্তু ঠিকই টের পাওয়া যায় বাইশ গজে তিনি ব্যাট করতে নামলে।
আজ সেই ‘অতিমানব’ই দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৫ হাজার রানের মাইলফলকের দেখা পেলেন। এভারেস্টের মতো এটাও তো একরকম উচ্চতাই, হয়তো ‘সাগরমাথা’র মতো অতটা উঁচু নয় এই মাইলফলক, কিন্তু যে চূড়ায় দেশের আর কোনো ক্রিকেটার পৌঁছাতে পারেননি, সেখানে পৌঁছাতে পারাটাই তো হিরণ্ময় সাফল্য। আর মুশফিক যোগ্যতর ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইলফলকটির দেখা পেলেন।
বলা ভালো, ক্রিকেট বহু আগে থেকেই এখানে একটি অলিখিত ধারা মেনে চলছে—যেসব ব্যাটসম্যান নিজ দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন, সবাই তাঁদের দেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই সেরা (ব্যাটসম্যান) ছিলেন। নিদেনপক্ষে কিংবদন্তি তো বলাই যায়।
নামগুলো একবার দেখুন—অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ‘ডন’ মানে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, ইংল্যান্ডের হয়ে ‘দ্য মাস্টার’ স্যার জ্যাক হবস, ভারতের হয়ে ‘লিটল মাস্টার’ সুনীল গাভাস্কার, নিউজিল্যান্ডের হয়ে জন রাইট, পাকিস্তানের হয়ে ‘এশিয়ার ব্র্যাডম্যান’ জহির আব্বাস, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে গ্যারি কারস্টেন, শ্রীলঙ্কার হয়ে ‘ম্যাড ম্যাক্স’ অরবিন্দ ডি সিলভা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে স্যার গারফিল্ড সোবার্স। শেষজনকে অনেকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবেও দেখেন। এঁরা সবাই টেস্টে নিজ নিজ দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন।
আজ মুশফিকও সে মাইলফলকের দেখা পাওয়ায় অন্তত এই জায়গায় ডন, মাস্টার, ম্যাড ম্যাক্সদের পাশে বসলেন, তা বলাই যায়!
ক্যারিয়ারের ৮১তম টেস্টে এসে ১৪৯তম ইনিংসে ৫ হাজার রানের মাইলফলকের দেখা পেলেন মুশফিক।
টেস্টে দেশের হয়ে প্রথম ৫ হাজার রান:
এই ৫ হাজার রান করায় যিনি টেস্ট ইতিহাসেই দ্রুততম, তিনি অস্ট্রেলিয়ারও প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রান করেছেন। কে আবার! সেই যে বেঁটেমতো লোকটা—ডন! ক্যারিয়ারের ৩৬তম ম্যাচে ৫৬তম ইনিংসে এসে মাইলফলকটির দেখা পেয়েছিলেন তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা এই ব্যাটসম্যান। তাঁর ব্যাটিং গড়টা ভুললে চলবে না। ৯৯.৯৪—ক্রিকেট ইতিহাসেই এক অনন্য সংখ্যা। ১৯৩৮ সালে লিডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৯ বছর ২৩৪ দিনের মাথায় ৫ হাজার রানের দেখা পান ডন ব্র্যাডম্যান।
‘দ্য মাস্টার’-এর সময় লেগেছে ২১ বছর। ভ্রু কুঁচকানোর কিছু নেই। ১৯০৮ সালে টেস্টে অভিষিক্ত জ্যাক হবসের ক্যারিয়ারের অনেক বছর রানের চাকা ঘোরেনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে। এর পাশাপাশি অসুস্থতাও একটি কারণ হয়তো। তবু টেস্ট ইতিহাসে হবস দ্বিতীয় দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন। সেটি ইনিংসের হিসেবে—ক্যারিয়ারের ৫৫তম টেস্টে ৯১তম ইনিংসে ‘ক্লাব ফাইভ থাউজেন্ডস’-এ ডনের সঙ্গী হন হবস।
ইংল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে হবস এই কীর্তি গড়েছিলেন ডনের টেস্ট অভিষেকের (১৯২৮) এক বছর পরই। অর্থাৎ, টেস্টে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ শতকের এই রেকর্ডধারি। পরে দ্রুততমের হিসেবে তাঁকে টপকে যান ডন।
মজার বিষয়, টেস্টে দ্রুততম ৫ হাজার রান করায় যিনি তৃতীয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে তিনি আবার প্রথম ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন। নামটা যেহেতু জানাই, তাই পরিসংখ্যানটা আগে জানিয়ে রাখা ভালো। টেস্ট অভিষেকের ১২ বছর ১২৭ দিনের মাথায় ৫৬তম ম্যাচে ৯৫তম ইনিংসে এসে এই মাইলফলকের দেখা পান সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার গ্যারি সোবার্স। ১৯৬৬ সালে সেই লিডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
টেস্টে দ্রুততম ৫ হাজার রান করায় যিনি চতুর্থ, তিনিও ভারতের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এই মাইলফলকের দেখা পেয়েছেন। ১৯৭৯ সালে বেঙ্গালুরু টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুনীল গাভাস্কার যখন এই মাইলফলকের দেখা পেলেন, তখন তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স ৮ বছর ১৯৭ দিন। খেলতে নেমেছিলেন নিজের ৫২তম টেস্টে ৯৫তম ইনিংস।
অর্থাৎ, টেস্ট ইতিহাসে দ্রুততম ৫ হাজার রানের তালিকায় শীর্ষ চার ক্রিকেটারই তাঁদের নিজ নিজ দেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এই মাইলফলকের দেখা পেয়েছেন।
জন রাইট ভারতের কোচ হিসেবে ২০০০ সালের শুরু থেকে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তবে ক্রিকেটার হিসেবেও দুর্দান্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালে মোরাতোয়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৭৮ তম টেস্ট এবং ১৪০ তম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পান রাইট। তখন তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স ১৪ বছর ২৯০ দিন।
পাকিস্তানের হয়ে প্রথম এই মাইলফলকের দেখা পাওয়া জহির আব্বাসের ক্যারিয়ার ৭৮ টেস্টের। ১৯৮৪ সালে নিজের ৭২তম টেস্টে ১১৬তম ইনিংসে এসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছিলেন জহির, তখন তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স ১৫ বছর ২৩ দিন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ওপেনার এবং কোচ গ্যারি কারস্টেন তাঁর দেশের হয়ে ৫ হাজার রানের দেখা পাওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের ৭৪তম টেস্টে ১৩১ তম ইনিংসে গিয়ে এই মাইলফলকের দেখা পান কারস্টেন। তখন তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স ৭ বছর ২৫৩ দিন।
কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের চোখে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসসেরা ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভা। ক্যারিয়ারের শুরুতে অপরিণামদর্শী সব শট খেলার জন্য ‘ম্যাড ম্যাক্স’ তকমা পাওয়া ডি সিলভার ব্যাট চওড়া হয়েছে সময়ের সঙ্গে। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৭৪ তম টেস্টের ১২৮তম ইনিংসে এসে ৫ হাজার রানের দেখা পান ডি সিলভা। তখন তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স ১৪ বছর ৫ দিন।
জিম্বাবুয়ের কোনো ব্যাটসম্যান টেস্টে ৫ হাজার রানের দেখা পাননি। সর্বোচ্চ ৪৯৭৪ রান করেছেন জিম্বাবুয়ের ইতিহাসসেরা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। ৬৩ ম্যাচে ১১২ ইনিংস ব্যাট করেছেন ‘রিভার্স সু্ইপ’কে নিখুঁত বানানো ফ্লাওয়ার।
টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৬ বছর ১১ মাস ২৩ দিনে এসে ৫ হাজার রানের দেখা পেলেন মুশফিক। অর্থাৎ, যেসব কিংবদন্তি দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন, স্যার জ্যাক হবস ছাড়া বাকি সবার চেয়ে বেশি সময় (বছর) লাগল মুশফিকের। ইনিংসের হিসেবে অবশ্য মুশফিকের মতো দেরি হয়নি আর কারও। তবু ওই যে দেশের হয়ে প্রথম কিছু করার আনন্দ ও গৌরবের তো তুলনা হয় না।
কে জানে, মুশফিক অবসর নেওয়ার পর হয়তো একদিন আলোচনার টেবিলে কথাটা উঠবে—অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ৫ হাজার রান করেছেন যে দুজন, ডানহাতি ব্যাটসম্যান হওয়া ছাড়া তাঁদের মধ্যে আরেকটি মিল আছে, সেটা কি?
দুজনের গড়ন যে প্রায় একই!