সাকিব আল হাসান এ প্রজন্মের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। একসময় তো তিন সংস্করণের র্যাঙ্কিংয়ে সেরাই ছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটের সেরায় এখন ভিন্ন নাম থাকলেও সব সংস্করণ মিলিয়ে চিন্তা করলে সাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু বেন স্টোকস ও রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে।
সাকিবের আলোচনাটা তাই এ প্রজন্মে আটকে থাকে না। বরং সর্বকালের সেরাদের তালিকাতে তাঁর স্থান কোথায় সে আলোচনাই চলে। খেলার মাঠে যেসব কীর্তি, প্রায়ই গ্যারি সোবার্স, জ্যাক ক্যালিস, ইমরান খান, কপিল দেব, ইয়ান বোথামদের সঙ্গে সাকিবের তুলনা চলে। ২০২১ সালে ক্রিকেট-বিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ক্রীড়া বিশ্লেষক অনন্ত নারায়ণন জানিয়েছেন, ওয়ানডেতে অলরাউন্ডারদের রাজা সাকিব। আর টেস্টে সোবার্সের পরেই দুইয়ে ছিলেন সাকিব। ইমরান, বোথাম বা রিচার্ড হ্যাডলিও পিছিয়ে ছিলেন নারায়ণনের বিভিন্ন পরিমাপকে।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ রিক ফিনলের গবেষণা বলছে ভিন্ন কিছু। ক্রিকেটের সব জটিলতম তথ্য পেতে এবিসির বিশ্লেষক ফিনলের কাছে ধরনা দেওয়া হয়। সর্বকালের সব টেস্ট খেলোয়াড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি যে তালিকা সৃষ্টি করেছেন, তার সেরা দশেও নেই সাকিব!
সর্বকালের সেরার তালিকা সৃষ্টিতে এমনিতেই নানা জটিলতা। কারণ, সাধারণ পরিমাপক, যেমন রান বা উইকেট, ব্যাটিং বা বোলিংয়ের গড় , স্ট্রাইকরেট, মাইলফলক ছোঁয়ার গতি—এসব দিয়ে সঠিক তুলনা দেওয়া অসম্ভব। দুই প্রজন্মের ব্যাটসম্যান বা বোলারদের মানের পার্থক্য, কন্ডিশনের পার্থক্য, কে কেমন দলে খেলেছেন—গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রভাবকের হিসাব এ ক্ষেত্রে থাকে না। যেমন ১৯ শতকে উইকেট ঢাকা না থাকায় অনেক কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানেরই গড় কম। আবার রিচার্ড হ্যাডলিকে প্রায় একাই নিউজিল্যান্ড দল টানতে হয়েছে। ওদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণকে নিজেদের মধ্যে উইকেট ভাগ করে নিতে হয়েছে।
অলরাউন্ডারদের ক্ষেত্রে তো কাজটা আরও জটিল। প্রাথমিকভাবে ব্যাটিং গড় থেকে বোলিং গড় বাদ দিয়ে একটা মান বের করা হতো। অর্থাৎ একজন অলরাউন্ডার ভালো হলে তাঁর ব্যাটিং গড় বোলিং গড়ের চেয়ে বেশি হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একজন ব্যাটসম্যান যিনি একটু-আধটু বল করেন, তিনিও এ তালিকায় ঢুকে পড়তে পারেন। আবার কারও ব্যাটিং ও বোলিং গড় যদি যথাক্রমে ৫০ ও ৪০ হয়, তাঁকে আরেক অলরাউন্ডার যাঁর ব্যাটিং ও বোলিং গড় যথাক্রমে ৪০ ও ৩০, তাঁর সমান দেখাবে। কিন্তু সবাই জানেন, একজন অলরাউন্ডার হিসেবে দ্বিতীয়জনই বেশি প্রার্থিত।
দ্বিতীয় আরেকটি প্রক্রিয়াও আছে—ব্যাটিং গড়কে বোলিং গড় দিয়ে ভাগ দেওয়া। সে ক্ষেত্রে ব্যাটিং গড় ৩০ ও বোলিং গড় ২০-এর একজন অলরাউন্ডার আর ব্যাটিং গড় ৬০ ও বোলিং গড় ৪০-এর আরেকজন অলরাউন্ডারকে সমানই মনে হবে! বিশ্লেষক অনন্ত নারায়ণন একটু ভিন্ন আরেকটা প্রক্রিয়া বের করে ব্যাটিং, বোলিং, প্রতি টেস্টে পারফরম্যান্স, অলরাউন্ড প্রভাব, উচ্চ অলরাউন্ড প্রভাব—সবকিছুর সূচক টেনে হিসাব কষে সাকিবকে দুইয়ে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কন্ডিশন, ভিন্ন প্রজন্মের ভিন্ন পরিস্থিতির হিসাবগুলো কিছুটা হলেও উপেক্ষিত হয়েছিল।
রিক ফিনলে তাই একটি পদ্ধতি বের করেছেন, যা কন্ডিশন, ভিন্ন দলের শক্তির পার্থক্য ও প্রজন্মের ব্যবধানের সমস্যাটা অনেকটাই দূর করে দিচ্ছে। তিনি প্রত্যেক খেলোয়াড়ের গড়কে তাঁর খেলা টেস্টগুলোতে অন্য খেলোয়াড়দের সম্মিলিত গড় দিয়ে ভাগ করেছেন। অর্থাৎ একজন ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে তাঁর গড়কে ওই টেস্টে খেলা ২২ জনের যে গড়, তা দিয়ে ভাগ করেছেন। এর ফল যদি ১-এর বেশি হয়, তিনি ওই সময়ে ওই একই কন্ডিশনে খেলা গড়পড়তা ব্যাটসম্যানদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ভাগফল যত বেশি, তিনি তত ভালো। এই ভাগফলকে তিনি বলছেন ‘এরা ইনডেক্স (প্রজন্ম সূচক)’।
তবে একটি দুর্বলতাও খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলের ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে তাঁদের বোলাররা প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের কম রানে গুটিয়ে দেওয়ায় দলগুলোর ব্যাটসম্যানদের সূচক ভালো আসবে। কিন্তু এ সূচকের আরেকটি দিক হলো, সে ক্ষেত্রে সর্বজয়ী দলের ব্যাটসম্যানদের নিজেদের মধ্যকার গড়ও কিন্তু এখানে বিবেচ্য হচ্ছে। অর্থাৎ গর্ডন গ্রিনিজ, ভিভ রিচার্ডস ও ক্লাইভ লয়েডদের ক্ষেত্রে সতীর্থদের গড় প্রভাব ফেলত। সত্যিকার অর্থেই তফাত গড়ে দেওয়া ব্যাটসম্যান ঠিকই এগিয়ে থাকবেন।
এই কঠিন কাজ বের করতে একজন অ্যাস্ট্রো ফিজিসিস্টের সাহায্য নিয়ে অন্তত ১০ টেস্ট খেলেছেন, এমন খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে ‘এরা ইনডেক্স’ (ইআই) বের করেছেন ফিনলে। উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন ইংল্যান্ডের দুই প্রজন্মের ব্যাটসম্যানকে। জো রুটের ব্যাটিং গড় ৪৯.২০, ওদিকে ডব্লু জি গ্রেসের ক্ষেত্রে সেটা ৩২.২৯। ১০০ বছরের বেশি সময়ের পার্থক্যে থাকা দুজনের মধ্যে রুটকেই ভালো দেখায়। কিন্তু ফিনলের সূচক অনুযায়ী জো রুটের ইআই ১.৭২১, যার মানে দুই দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের গড়ের চেয়ে ১.৭১৩ গুণ ভালো তিনি। গ্রেসের ক্ষেত্রে সেটা ১.৭২৩। অর্থাৎ দুই প্রজন্মের দুই সেরা ব্যাটসম্যানের পার্থক্য আসলে খুব বেশি না। অথচ গড় দেখে সেটা বোঝার উপায় ছিল না।
ফিনলের সূচকে সেরা পাঁচ তাই চমকে দিচ্ছে। রানের তালিকার শীর্ষে থাকা কেউ নেই। আছেন নিজ নিজ সময়ে নিজেদের বিশেষ কিছু প্রমাণ করেছেন যাঁরা, তাঁরা। শীর্ষে যথারীতি সেই একজন, পরিসংখ্যান মানেই যিনি থাকেন, অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান (ইআই-৩.৩৯৫!), ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হেডলি (২.২১৯), ইংল্যান্ডের ববি অ্যাবেল (২.২১৬), অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম ভোজেস (২.০৪৮) এবং নিউজিল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ডেম্পস্টার (২.০৩৯)।
বর্তমান প্রজন্মের মাত্র দুজন শীর্ষ ২০-এ আছেন। স্টিভ স্মিথ আছেন আটে, তাঁর সতীর্থ মারনাস লাবুশেন আছেন ১৭-তে। বিরাট কোহলি আছেন ৩৬-এ। উইলিয়ামসন ৪০তম, রুট ৪২তম, বাবর আজম ৮০তম। একফাঁকে কয়েকজন কিংবদন্তি, যাঁদের নাম এ প্রজন্মের কাছে বেশ পরিচিত, তাঁদের অবস্থানও জেনে নেওয়া যাক—ব্রায়ান লারা (১৮), গ্যারি সোবার্স (২৫), ভিভ রিচার্ডস (২৬), জ্যাক ক্যালিস (২৭), রিকি পন্টিং (৫৮) ও শচীন টেন্ডুলকার (৬৬)।
এদিক থেকে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অবস্থান যে ভালো হবে না, সেটা জানা ছিল। সাকিব আল হাসানই সবচেয়ে এগিয়ে। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৩১০-এ আছেন সাকিব। এরপর তামিম ইকবাল (৩২৫), লিটন দাস (৩৫০), মুমিনুল হক (৩৬০), হাবিবুল বাশার (৪৪১) ও মাহমুদউল্লাহ (৪৯৮)।
মুশফিকুর রহিমের অবস্থানটা চমকে দেয়। টানা দুই ইনিংসে শতক পাওয়া ও বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে দ্বিশতক করা মুশফিকের অবস্থান অনেক পেছনে। ১৩৩২ জন ব্যাটসম্যান, যাঁরা অন্তত ১০ টেস্ট খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে ১০৭১তম মুশফিক। সবার শেষে (১৩৩২) আছেন ইবাদত হোসেন।
বোলারদের ক্ষেত্রে ফিনলে একজন বোলারের তাঁর গড়কে ওই টেস্টে বল করা বাকিদের যে গড়, তা দিয়ে ভাগ করেছেন। এর ফল যদি ১-এর কম হয়, তিনি ওই সময়ে ওই একই কন্ডিশনে খেলা গড়পড়তা বোলারদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ভাগফল যত কম হবে, তিনি তত ভালো। অন্তত ১০ টেস্টে বল করেছেন, এমন ৭৯৪ জন বোলারের ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা নামটি কিছুটা হলেও চমকে দেয়।
ব্র্যাডম্যানের ইনভিন্সিবল দলের সদস্য ছিলেন আর্নি টোশাক। এই বাঁহাতি পেসারের ইআই ০.৫৫৩। পরের দুটি নাম অবশ্য অনুমিত। ইংল্যান্ডের সিডনি বার্নস (০.৫৮০) ও জর্জ লোহমান (০.৫৯৩)। চারে আছেন অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি স্পিনার বার্ট আয়রনমঙ্গার (০.৬০৪)। এ প্রজন্মের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শীর্ষ পাঁচে আছেন নিউজিল্যান্ডের কাইল জেমিসন (০.৬০৮)।
ব্যাটিংয়ে স্মিথ আটে ছিলেন। সাবেক অধিনায়কের পথ ধরে বর্তমান অধিনায়ক প্যাট কামিন্সও (০.৬৩৮) আছেন বোলারদের আটে। শাহিন শাহ আফ্রিদি (০.৭৩০) আছেন ৪০-এ। ভারতের স্পিন জুটি রবীন্দ্র জাদেজা (৪৭) ও রবিচন্দ্রন অশ্বিনের (৫৩) অবস্থানও বেশ ভালো। বর্তমান প্রজন্মের জেমস প্যাটিনসন (৬৬), জশ হ্যাজলউড (৬৮), লুঙ্গি এনগিডি (৮০), কাগিসো রাবাদা (৮৪) ও জিমি অ্যান্ডারসন (৮৬) এক শর মধ্যে জায়গা পেয়েছেন।
গত প্রজন্মের মুত্তিয়া মুরালিধরন আছে সাতে, গ্লেন ম্যাকগ্রা আছেন নয়ে, তাঁর সতীর্থ স্টুয়ার্ট ক্লার্ক দশে। ডেল স্টেইনের অবস্থান ১৩। কিন্তু শেন ওয়ার্নের অবস্থান ৫৪! টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের তালিকায় ছয়ে থাকা স্টুয়ার্ট ব্রড আছেন ১৩৫-এ। সাকিব আল হাসানের অবস্থান? ২২৮। তাঁর ইআই সূচকই ০.৯১৩, অর্থাৎ তাঁর খেলা ম্যাচে অন্য বোলারদের চেয়ে সাকিবের গড় ভালো থাকে। কিন্তু বিশ্বমানের চেয়ে তিনি অনেকটাই পিছিয়ে।
ব্যাটিং ও বোলিং দুই ক্ষেত্রেই এভাবে বেশ পিছিয়ে থাকা সাকিবকে অলরাউন্ডারর তলিকাতেও পিছিয়ে দিয়েছে।
যেহেতু ব্যাটিং ও বোলিং সূচকেই প্রজন্ম, কন্ডিশন ও অন্যান্য পরিমাপকের হিসাব হয়ে গেছে। তাই অলরাউন্ডারদের তালিকা বের করতে ব্যাটিং ইআইকে বোলিং ইআই দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ যার ব্যাটিং ইআই একের বেশি এবং বোলিং ইআই একের কম, তাঁর ক্ষেত্রে ফল ভালো আসবে।
এই হিসাবে ১.৮৭১ ইআই নিয়ে সবার শীর্ষে দক্ষিণ আফ্রিকান জ্যাক ক্যালিস। এরপর পাকিস্তানের ইমরান খান (১.৮৬৮) ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্যারি সোবার্স (১.৮৬৬)। চারে আছেন অস্ট্রেলিয়ার কিথ মিলার (১.৭৫৯)। শীর্ষ পাঁচে বাকিজন ইংল্যান্ডের ওয়ালি হ্যামন্ড (১.৬৪৯)।
বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে শুধু রবীন্দ্র জাদেজা আছেন শীর্ষ দশে। ১.৫৭৯ সূচক মান নিয়ে জাদেজা আছেন সাতে। স্টিভ ওয়াহ ও শন পোলক আছেন আট ও নয়ে। সাকিব আল হাসানের অবস্থা ১৪ (১.৩৫২)।