‘টেস্ট সংস্কৃতি’র অভাব তো সবখানেই
অ্যান্টিগার পর সেন্ট লুসিয়ায় এসেও ছবিটা বদলায়নি এতটুকু। বাংলাদেশের ব্যাটিং যেন টেস্ট ক্রিকেটের সুরটাই হারিয়ে ফেলেছে! এর মধ্যেই অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের এক বক্তব্য জন্ম দিয়েছে নতুন আলোচনার। পরশু ম্যাচ শেষে সাকিব বলেছেন, বাংলাদেশে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতিটাই তৈরি হয়নি।
সাকিবের কথা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু তিনি ভুল কিছু কি বলেছেন? আর টেস্ট ক্রিকেট দেখতে বাংলাদেশে দর্শক আসেন না বললেও তিনি তাঁদের খারাপ খেলার দায়টা তো দর্শকদের দেননি। পরে আরেক বক্তব্যেই বলেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই অবস্থার দায় খেলোয়াড়দেরও আছে। খেলোয়াড়েরা ভালো খেলেন না বলেই সাদা পোশাকের ক্রিকেট বাংলাদেশে সেভাবে মূল্যায়িত হয় না। আবার দেশে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতি তৈরি হয়নি বলে খেলোয়াড়দের মধ্যেও টেস্টের প্রতি ভালোবাসাটা তেমন জাগে না। খেলোয়াড়দের ভালো খেলা এবং দেশের ক্রিকেটের সর্বস্তরে টেস্ট ক্রিকেটের মূল্যায়ন একটি আসলে আরেকটির পরিপূরক।
টেস্ট ক্রিকেটকে বাংলাদেশের গুরুত্ব না দেওয়ার তাজা উদাহরণটা চলতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেই দেওয়া যায়। সফরের একেবারে শুরু থেকে বাংলাদেশ দলের সূচিটা দেখুন। কোচ, খেলোয়াড়েরা কবে কীভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যন্ত এলেন? কীভাবে অনুশীলন করলেন?
সফরের একেবারে শুরু থেকে বাংলাদেশ দলের সূচিটা দেখুন। কোচ, খেলোয়াড়েরা কবে কীভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যন্ত এলেন? কীভাবে অনুশীলন করলেন?
কী ধরনের উইকেটে প্রস্তুতি ম্যাচ খেললেন? সফরের শুরু থেকে অ্যান্টিগার স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্ট খেলতে নামার আগপর্যন্ত দলের প্রস্তুতিটা কি যথাযথ হয়েছে? দলের অন্দরমহলে কান পাতলে বিসিবির শীর্ষ কর্তারাও নিশ্চিত এ নিয়ে চাপা অসন্তোষের খোঁজ পাবেন।
বিদেশে টেস্ট খেলতে গেলে হাতে যথেষ্ট সময় নিয়েই যেতে হয় যেন খেলায় নামার আগে প্রস্তুতিটা ভালো হয়, কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কাজটা সহজ হয়। আর যেকোনো খেলার জাতীয় দল কোথাও খেলতে গেলে একসঙ্গে যাবে, এটাই তো সংস্কৃতি। খুব জরুরি কারণ ছাড়া এর ব্যত্যয় আন্তর্জাতিক দলগুলো কমই ঘটায়।
অথচ এবার শুধু বাংলাদেশের টেস্ট দলটাই ওয়েস্ট ইন্ডিজে এল পাঁচ–ছয় ভাগে! সব যেন আলাদা আলাদা দল, কেমন ছাড়া ছাড়া। প্রথমে এলেন শুধু ছয় খেলোয়াড়, সঙ্গে কোনো কোচিং স্টাফের সদস্য ছিলেন না। খেলোয়াড়েরা অ্যান্টিগায় পৌঁছে দূরের এক রিসোর্টে কয়েকটা দিন নিভৃত জীবন কাটানোর পর তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কোচদের বহর এবং আরও কয়েকজন খেলোয়াড়। কোচরাও এসেছেন কেউ বাংলাদেশ থেকে, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। অধিনায়ক সাকিব একা আসেন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে। এনামুল হক আর শরীফুল ইসলাম তো এসেছেনই অ্যান্টিগা টেস্টের পর, সেটিও আলাদা আলাদা বিমানে।
বিসিবি অবশ্য তখনই ব্যাখ্যা দিয়েছিল, লন্ডন থেকে অ্যান্টিগা যাওয়ার বিমানে বিজনেস ক্লাসে একসঙ্গে বেশি টিকিট পাওয়া যায়নি বলেই এভাবে সবাইকে আলাদা আলাদা আসতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ দল এই সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসবে, সে তো জানাই ছিল। এসব ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় না থেকে আগেই বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে দিলেই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব।
তো দূরদেশে যখন এভাবে একটা দল টেস্ট খেলতে আসে, একসঙ্গে বসে খেলার পরিকল্পনাটাই তো ঠিকঠাক করা যায় না। অ্যান্টিগায় ছয় ক্রিকেটার যে আগে গিয়েছিলেন, তাতে তাদের কি লাভ হয়েছে? ওই ছয় দিন সেখানে তাঁদের অনুশীলনের কোনো সুযোগই ছিল না, হোটেলে জিম–সুইমিং করে শুধু ফিটনেসের কাজটাই করা গেছে। আর বাংলাদেশ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যন্ত যাত্রাটা সব মিলিয়ে পড়ে যায় ২৬–২৭ ঘণ্টার। ১০ ঘণ্টা সময় ব্যবধানের কারণে রাত–দিনের হিসাবও পুরো উল্টো হয়ে যায়। এরপর ভ্রমণক্লান্তি দূর করতেই লেগে যায় দুই দিন।
অ্যান্টিগায় সবাই জড়ো হওয়ার পর পুরো দলের একসঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ তাই খুব অল্পই পাওয়া গেছে। মাঠে গিয়ে ঠিকঠাক প্রস্তুতির কথা যদি বলেন, প্রথম টেস্টের আগে বাংলাদেশ দল সাকল্যে সেটি করেছে মাত্র দুই দিন। এই দুই দিনের মধ্যে কুলিজ ক্রিকেট মাঠে একটি প্রস্তুতি ম্যাচ তারা খেলেছে, যেটির উইকেট আর স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের উইকেট স্বাভাবিকভাবেই একরকম ছিল না। তা ছাড়া প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয় একটা জায়গায় গিয়ে কয়েক দিন অনুশীলনের পর সামর্থ্যটাকে ম্যাচ পরিস্থিতিতে যাচাই করে নিতে এবং কন্ডিশনের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে মানিয়ে নিতে। কিন্তু নতুন জায়গায় গিয়ে যখন অনুশীলনটাই পর্যাপ্ত হয় না, তখন এ রকম প্রস্তুতি ম্যাচ শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতাই হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে যেই দেশের দল টেস্ট খেলতে যায়, সেই দেশে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, কথাটা কি খুব ভুল? তা–ও এটি তো অতি সামান্য একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশ যে টেস্ট জাতি নয়, তার আরও হাজারটা উদাহরণও চাইলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। তবে সেসবের কোনোটিই খেলোয়াড়দের বাজে পারফরম্যান্সের পক্ষে যুক্তি হবে না। সাকিব যেটা বললেন, ভালো ক্রিকেট খেলে টেস্ট সংস্কৃতির ইট গাঁথার কাজে তাঁদেরই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
ওহ্, একটা কথা তো বাদই পড়ে যাচ্ছে। টেস্ট সিরিজ শেষে সেন্ট লুসিয়া থেকে ডমিনিকা যাওয়া নিয়েও বিপত্তিতে পড়েছিল বাংলাদেশ। আজ সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাঁচ ঘণ্টার ফেরিযাত্রায় তাদের ডমিনিকা যাওয়ার কথা। কিন্তু আটলান্টিকে ওঠা সাইক্লোনের কারণে সেন্ট লুসিয়া সরকারের জারি করা সতর্কবার্তার পর এখন এক দিন পিছিয়ে কাল সকালে ডমিনিকার উদ্দেশে রওনা দেবে দল। তারপরও সমুদ্রযাত্রায় অনভ্যস্ত ক্রিকেটারদের দীর্ঘ ফেরিভ্রমণ নিয়ে একটা অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে।