টন্টনে মাশরাফিদের যেভাবে বোলিং করতে হবে
টন্টনে সোমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ওখানকার পেসবান্ধব উইকেটে বাংলাদেশের বোলিং কেমন হওয়া উচিত? জানিয়েছেন সাকিব আল হাসানের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন
২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টন্টনে কাল পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে নিশ্চয়ই চোখ রেখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা? ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের ম্যাচটা তো ওখানেই। দলের পেসারদের নিশ্চয়ই চোখ চকচক করেছে। কাল মোট ২০ উইকেটের মধ্যে ১৭টিই পেয়েছেন দুই দলের পেসাররা। বোঝাই যাচ্ছে, ওখানকার ২২ গজ আসলে পেসারদের ‘ঘর’। কিন্তু সেই ঘর থেকে ব্যাটসম্যানদের হটিয়ে সুখ-শান্তির নিবাস গড়তে যে গতিটুকু দরকার তা আছে?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিন্তু আছে। টন্টনের পেসবান্ধব উইকেট দেখে ওশানে টমাস, শেলডন কটরেলদের জিবে জল চুকচুক করাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পেসারদেরও অনুভূতিও তার বাইরে হওয়ার কথা নয়। গতি যা–ই হোক পেসার তো! ক্যারিবীয় পেসারদের সঙ্গে মোস্তাফিজ-মাশরাফিদের এই গতিতেই যা মোটাদাগের পার্থক্য। তবে কালকের ম্যাচটা ভালোভাবে দেখে থাকলে আশার জায়গাও কিন্তু আছে। মূল প্রশ্ন হলো, ক্যারিবীয় ‘পাওয়ার হিটার’দের বিপক্ষে টন্টনের ঘেসো-বাউন্সি উইকেটে বোলারদের সঠিক লেংথটা ঠিক কোথায়? সেটি শুধু পেসার নয়, স্পিনারদের জন্যও।
সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন ক্রিকেটার গড়ার কারিগর কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থানীয় অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের সরাসরি ‘গুরু’। মুমিনুল হক আর নাসির হোসেনেরও। কাল মোহাম্মদ আমিরের বোলিং নিয়ে কথার ফাঁকে সালাউদ্দিনের মত, পেসারদের সামনেই বল করতে হবে।
কাল তো আমিরের আগুনঝরা বোলিং দেখেছেন? বাঁহাতি এ পেসারের গতি আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকে। আমির কিন্তু পেছনে মানে শর্ট লেংথে খুব কমই বল করেছেন। কারণ, বাউন্সি উইকেটে পেছনে কয়েকটি বল করায় তা বুকসমান উচ্চতায় উঠেছে, পুল-হুক খেলতে বেশ আরাম পাচ্ছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার-অ্যারন ফিঞ্চ। আমির বুদ্ধিদীপ্ত পেসার, তাই খুব দ্রুতই লেংথ পাল্টে সামনে, মানে ‘ফুল পিচ’ ডেলিভারি শুরু করেন। পরে যা অনুসরণ করেছেন ওয়াহাব রিয়াজও ও শাহিন আফ্রিদিও।
ফুল পিচ ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানরা মারার কিছু সুবিধা পেলেও উইকেট নেওয়ার জন্য—বিশেষ করে যদি গতি থাকে তাহলে—বেশ কার্যকর। চালাতে গিয়ে স্লিপ কিংবা থার্ডম্যানে ক্যাচ ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সঙ্গে স্টাম্পে থাকা বল সিমে পরলে মুভমেন্ট একটু এদিক হলেই বোল্ড কিংবা ৩০ গজের মধ্যে ক্যাচ ওঠার সম্ভাবনাও থাকে। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে বিশেষ করে শেষ ১০ ওভারে পাকিস্তানের পেসাররা বিশেষ করে আমির কিন্তু এই ফুল পিচ ডেলিভারিতেই উইকেটগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের পেসাররাও কি তাহলে একই লেংথ অনুসরণ করবেন?
এখানে মৌলিক একটা সমস্যা থেকে যায়। সেটি অবশ্যই গতির খামতি। কম গতিতে ফুল পিচ ডেলিভারিতে মার খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কারণ, ব্যাটসম্যানরা সময় বেশি পান। আর ক্রিস গেইল কিংবা আন্দ্রে রাসেলদের কাছে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়টুকু বেশি পাওয়াই বোলারদের ‘খুন’ করার জন্য যথেষ্ট। তাহলে? সালাউদ্দিন কিন্তু মনে করছেন, পেসারদের তবু সামনেই বল করতে হবে। দেশের ক্রিকেটে ভীষণ শ্রদ্ধাভাজন এ কোচের ব্যাখ্যাটাও যৌক্তিক, ‘পেসারদের জন্য লেংথে বল করা সহজ। যেহেতু বাউন্সি উইকেট লেংথে করলে বল স্টাম্পের বেলসের উচ্চতা থেকে একটু বেশিই উঠবে। তাতে তুলে খেলাটা সহজ, যেহেতু গতি কম আর মাঠের (টন্টন) সীমানাও ছোট, তাই সামনে (ফুল পিচ) বল করলে রান আটকানোর সঙ্গে অন্তত উইকেট নেওয়ার সুযোগটাও বেশি থাকবে।’
সাধারণত, বল যেখানে পিচ করার পর স্টাম্পের বেলস–সমান উচ্চতায় ওঠে, সেটি পেসারদের জন্য আদর্শ লেংথ। বাউন্সি উইকেটে কম গতির পেসারদের সমস্যা হলো, মন্থর উইকেটে যে জায়গাটি তাঁর জন্য আদর্শ লেংথ, বাউন্সি উইকেটে তা নয়। একই জায়গা থেকে বল ঢিমেতালে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। মাঠ ছোট হলে তা মারতেও সুবিধা—অন্তত গেইল, হেটমায়ার, রাসেলদের জন্য তো বটেই। আর শর্ট বল করার তো সুযোগই নেই। সেটি কেন, তা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাশরাফির ৪৯তম ওভারের বোলিং মনে করলেই পরিষ্কার বুঝে নেওয়া যায়। লেংথ আর কিছুটা শর্ট বল করার চেষ্টা করেছিলেন মাশরাফি। একটু উঠে আসা ডেলিভারিগুলোয় গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ মাইল গতি থাকায় মারতে আরাম বোধ করেছিলেন ওকস-প্লাঙ্কেটরা।
কাল দুই দলের পেসারদের আরেকটি বিষয় ছিল চোখে পড়ার মতো। তেমন একটা সুইং পাননি কোনো দলের পেসারই। তবে সিম মুভমেন্ট ছিল। কেন রিচার্ডসন, হাসান আলীর বল হুট করেই ভেতরে ঢুকেছে। অর্থাৎ উইকেটে বল কিছুটা হলেও ‘কাট’ করছে। সালাউদ্দিন তাতে মোস্তাফিজ-মাশরাফির ভালো বোলিংয়ের সম্ভাবনা দেখছেন, ‘কাল উইকেটে বল কাট করেছে। মোস্তাফিজের জন্য ভালো হবে। আর মাশরাফির অফ কাটারও আছে।’
বাংলাদেশের আগের তিন ম্যাচে মোস্তাফিজের বল উইকেটে তেমন ধরেনি। ইংলিশ উইকেট যেহেতু উপমহাদেশের মতো মন্থর না, তাই ওটাই স্বাভাবিক। কিন্তু টন্টনে মোস্তাফিজের বল উইকেটে ধরলে আর সঙ্গে একটু গতি থাকলে তা ভয়ংকর হয়ে ওঠার কথা। তা না হলে বুদ্ধি খরচ করতে হবে, গতি কমলেও যেটির বদৌলতে মাশরাফি এখনো ব্যাটসম্যানদের মাথাব্যথার কারণ। ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানেরা এমনিতে বল ব্যাটে আসুক—তা পছন্দ করেন। ভালো টাইমিং করলেই ছোট মাঠ পার করতে সুবিধা। সে ক্ষেত্রে মাশরাফির ওভারগুলোয় স্লোয়ার-কাটারের মিশ্রণ ভালো হলে ক্যারিবীয়দের বিপদ হতেই পারে।
বাংলাদেশের বোলিংয়ে শক্তির জায়গা বিবেচনা করলে স্পিনাররাই এগিয়ে। উইকেট যেমনই হোক, জাতীয় দলের বরাবর স্পিননির্ভরতাই তার প্রমাণ। টন্টনের পেসবান্ধব উইকেটেও সাকিব-মিরাজদের জন্য কিন্তু আশার জায়গা রয়েছে। কাল পাকিস্তান ইনিংসে কিন্তু গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বেশ ভালোই বাঁক পেয়েছেন। কিন্তু পায়ের কাছে হাফভলি লেংথে কিংবা ব্যাটসম্যানের কবজির আওতার মধ্যে বল করলে কী ঘটতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছেন একজন পেসার—ওয়াহাব রিয়াজ! তাহলে গেইল-রাসেলরা ওসব ডেলিভারি পেলে কেমন করবেন তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠার কথা। এখনই ভয়ের কিছু নেই। কারণ, শিষ্য সাকিব এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিণত বলেই মনে করেন সালাউদ্দিন, সঙ্গে মিরাজও।
যেহেতু মাঠ ছোট, উইকেটে বল বাঁক নিলে কী করতে হবে সাকিব-মিরাজ তা জানেন। বাঁক না নিলে ‘স্টাম্প বরাবর বোলিং করতে হবে’—পরামর্শটুকু জেমি সিডন্সের আমলে সহকারী কোচের ভূমিকা পালন করা সালাউদ্দিনের। ঘরোয়া লিগ ক্রিকেট ও বিপিএলে নানা দলকে চ্যাম্পিয়ন করা এ কোচের উক্তি, ‘স্পিনারদের লেংথেই বল করতে হবে। বাঁক নিলে কিংবা না নিলে কী করতে হবে সাকিব-মিরাজ সেটি জানে। মাঠ যেহেতু ছোট, হাফভলি কিংবা পায়ের কাছে না করাই ভালো।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুরুতে বল করেছিলেন সাকিব। সেই ম্যাচের শুরুতে জ্যাসন রয় ও জনি বেয়ারস্টোর বিপক্ষে বল করেছিলেন দারুণ নিয়ন্ত্রিত লেংথে। রয়-বেয়ারস্টো যতই সরে গিয়ে জায়গা করার চেষ্টা করেছেন, সাকিব ততই বল ভেতরে ঢুকিয়েছেন। এমন বুদ্ধি আর নিয়ন্ত্রণটুকু থাকলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের বেঁধে রাখা সম্ভব। আর যেহেতু পেসবান্ধব উইকেট, তাই স্লগ ওভারে গতির সঙ্গে ফুল পিচ ডেলিভারি অথবা ইয়র্কারের ‘অপশন’ রাখতে দলে রুবেল হোসেনের অর্ন্তভুক্তিটা সম্ভবত সময়ের দাবি।
এই দাবি পূরণে বাংলাদেশ কি চার পেসার খেলাবে? সালাউদ্দিন মনে করেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের শক্তি বিবেচনায় চার পেসার খেলানো এখনো বিলাসিতা।’ এতে ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা কমে যায় বলে মনে করেন তিনি—কারণ, পেসারদের কেউ ব্যাটিংয়ে তেমন একটা দক্ষ নয়—না মারতে, না উইকেটে থাকতে।
সোমবার টন্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে ওঠার আশা জিইয়ে রাখতে ম্যাচটা জেতার বিকল্প নেই বাংলাদেশের জন্য। আর ক্রিকেট রসিক মাত্রই জানেন, জয় তুলে নিতে আঁটসাঁট কৌশলটা লাগে সবার লাগে। আশার বিষয় হলো, দলের ম্যানেজমেন্টের চেয়ে সেটি আর কেউ ভালো জানে না।