চার মিনিট আগে-পরের যমজ ইতিহাস গড়েছিল সেদিন
ফ্লাওয়ার, মার্শাল, বেডসার ও ওয়াহ। মিলটা কোথায় বলতে পারেন?
ঠিক ধরেছেন। ক্রিকেট খেলুড়ে ভাইয়েরা। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে ফ্লাওয়ার ভাইয়েরা তো বিখ্যাত। ইংলিশ ক্রিকেটে তেমনি বেডসার। লোকে বলে, দুই যমজ অ্যালেক ও এরিককে আলাদা করতে পারতেন শুধু তাঁদের মা। ওয়াহ ভাইয়েরা যমজ হলেও অবশ্য আলাদা করে চেনা যায়। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে মার্শাল ভাইদের—হামিশ ও জেমস—অবশ্য আলাদা করে চেনা কষ্ট। ক্রিকেটে এমন আরও আছে। দুই ভাই ক্রিকেটার, এমনকি দুইয়ে অধিকও!
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের খেলার নজিরও আছে। টেস্টেও এমন নজির আছে। ১৮৮০ সালে ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ইংল্যান্ড দলে খেলেছিলেন এডয়ার্ড, উইলিয়াম এবং ফ্রেড—তিনজনের নামের শেষ অংশটুকু ‘গ্রেস’। হ্যাঁ, গ্রেস ভাইয়েরা। তাদের মধ্যে বিখ্যাতজন সেই দাড়িওয়ালা চিকিৎসক ডব্লিউ জি গ্রেস। ওই ঘটনার ১২ বছর পর কেপটাউনে ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টে তিন ভাই খেলেছিলেন দুই দলের হয়ে। অ্যালেক ও জর্জ হেয়ার্নে খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেছিলেন ফ্রাঙ্ক হেয়ার্নে। ১৯৬৯ সালে করাচিতে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড টেস্টে এক সঙ্গে খেলেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ, সাদিক মোহাম্মদ ও মুশতাক মোহাম্মদ।
কিন্তু এ লেখা এক ম্যাচে কয়জন ভাই খেললেন তা নিয়ে নয়। টেস্টে সর্বপ্রথম কবে দুই যমজ ভাই ম্যাচ খেলেছেন একসঙ্গে?
২৯ বছর আগে। পোর্ট অব স্পেনে। ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে থাকলে এই যমজ ভাইদের নাম দুটো মুখে চলে আসার কথা। স্টিভ ওয়াহ এবং মার্ক ওয়াহ। স্টিভের জন্মের চার মিনিট পরে জন্মেছিলেন মার্ক। অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেকেও মার্কের চেয়ে ৬ বছর এগিয়ে ছিলেন স্টিভ।
তবে দুজনের একসঙ্গে খেলার শুরু বেশ আগে থেকে। সাত বছর বয়স থেকেই নানা দলে একসঙ্গে খেলেছেন দুজন। ফস্টার শিল্ডে ব্যাংকসটাউনের অনূর্ধ্ব-১০ দলের হয়ে একসঙ্গে খেলেছিলেন দুই ভাই। দশ নম্বর এবং এগারো নম্বরে ব্যাট করেছিলেন দুজন। কত রান করেছিলেন সে প্রশ্ন থাক। তবে স্টিভ ওয়াহ পরে বলেছিলেন, ওই ম্যাচে দল ‘এমন দুজন ফিল্ডার পেয়েছিল যারা সব ডেলিভারিতেই চাইত, বলটা তাদের কাছেই আসুক।’
হাই-স্কুল পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হিসেবে নজর কেড়েছিলেন ওয়াহ ভাইয়েরা। আত্মজীবনী ‘আউট অব মাই কমফোর্ট জোন’-এ স্টিভ জানিয়েছিলেন, স্কুল পর্যায়ে একবার তাদের শিক্ষক একটি ট্রায়াল সমন্ধে আগেভাগে জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। সেই ট্রায়ালের দলও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্টিভ ও মার্কের জন্য তা আবারও অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই দলের রাখা হয়েছিল দুই ভাইকে। আরও কয়েক বছর পর দুজনে ইংল্যান্ডে অফ-সিজনে বোল্টন লিগ খেলে কামিয়েছেন দু-পয়সা। এরপর ধীরে ধীরে খুলে গেল আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা রাখার দুয়ার। যেখানে স্টিভ পা রেখেছিলেন ভাইয়ের আগে।
ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্যের কথা উঠলে মার্ক ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা। স্টিভ সে তুলনায় লড়াকু, মানসিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব, যা তাঁকে পরে গড়ে তুলেছে কিংবদন্তি অধিনায়ক হিসেবে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে অ্যাডিলেড ওভালে মার্কের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তারই ভাইয়ের জায়গায়! রানখরায় ভুগছিলেন স্টিভ। নিজে জায়গা হারিয়েছেন, আর সেখানে ঢুকেছেন নিজেরই ভাই মার্ক—এ খবরটা পরিবারকে প্রথম জানিয়েছিলেন স্টিভ নিজেই। প্রতিক্রিয়াটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘মার্কের জন্য মা ভীষণ খুশি হয়েছিল, কষ্ট পেয়েছিল আমার জন্য। বহুদিন শিক্ষানবিশ হয়ে থাকার পর দলে ডাক পেয়ে মার্ক অবশ্য তেমন আহ্লাদিত হয়নি।’
১৯৮৫ সালে অভিষিক্ত স্টিভের ততদিনে আন্তর্জাতিক ময়দানে ৪২ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মার্ক অভিষেকেই ১৩৮ রানের ইনিংস খেলে বুঝিয়েছিলেন নিজের জাত। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্টে ডেভন ম্যালকম, অ্যাঙ্গেস ফ্রেজার, ফিল ডিফ্রেইটাসদের রেশমি টাইমিংয়ে সীমানা পার করেছিলেন মার্ক। আউট হয়ে আসার পর অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারকে মার্ক বলেছিলেন, ‘বলেছিলাম না! আমাকে আরও আগে দলে নেওয়া উচিত ছিল।’
স্টিভের মতে, নিজের সামর্থ্য নিয়ে এটাই মার্কের সেরা উক্তি।
দুই মাস পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেল অস্ট্রেলিয়া। সেখানে তৃতীয় টেস্টে খুলে গেল দুই ভাইয়ের একসঙ্গে খেলার দুয়ার। কুইন্স পার্ক ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একসঙ্গে মাঠে নামলেন দুই যমজ ভাই মার্ক ও স্টিভ। টেস্ট ইতিহাসে একসঙ্গে ম্যাচ খেলা প্রথম যমজ ভাই তাঁরা দুজন। ছেলেদের ক্রিকেটে প্রথম যমজ হিসেবে একসঙ্গে টেস্ট ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তাদের। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম যমজ হিসেবে একসঙ্গে ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি নিউজিল্যান্ডের দুই নারী ক্রিকেটার এলিজাবেথ ও রোজমেরি সিগন্যালের। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে একসঙ্গে মাঠে নেমেছিলেন এ দুই যমজ বোন।
সে যাই হোক, বৃষ্টিবিঘ্নিত সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া দুই ইনিংসে ব্যাট করলেও শুধু প্রথম ইনিংসে প্যাড পরে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন স্টিভ ও মার্ক। অ্যামব্রোস, প্যাটারসন, মার্শাল ও ওয়ালসদের বিপক্ষে মার্ক ১৮১ বলে ৬৪ করলেও স্টিভের ২৬ রান প্রভাব রাখতে পেরেছিল সামান্যই। কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাস পরে স্টিভকে মনে রেখেছে কিংবদন্তি অধিনায়ক হিসেবে।
২০০২ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাশেজ সিরিজের আগে টেস্ট দলে থেকে বাদ পড়েন মার্ক। তার আগে দুই ভাই মিলে একসঙ্গে খেলেছেন ১০৮ টেস্ট। রান করেছেন ১৪৩২৬ আর সেঞ্চুরি ৪১টি! এই অবিস্মরণীয় যাত্রার শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে এই দিনে!